নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে দলীয় অফিসের সামনে সংঘর্ষে একজন নিহত হন। বিএনপির অফিসে পুলিশের অভিযান, পাইকারি গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ থেকে দলীয় সাত সংসদ সদস্যের পদত্যাগের ঘোষণা এসেছে। এ প্রেক্ষাপটে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে
অনেক অনিশ্চয়তা ও সংশয়ের পর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
মাহবুবউল্লাহ: ঢাকায় বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ায় একধরনের তৃপ্তিবোধ কাজ করছে। গত কয়েক দিনে নানা শঙ্কায় মন খুব বিষণ্ন হয়ে ছিল। সেই বিষণ্নতা কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেছে। তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়ার সুযোগ দেখি না।
সমাবেশের জায়গা নিয়ে নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। সমাবেশের জায়গা নিয়ে বিএনপি কেন অনড় থাকল?
মাহবুবউল্লাহ: বিএনপির প্রধান আপত্তি ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে। দলটির নেতাদের বক্তব্য ছিল, এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর আগের মতো নেই। চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা, প্রবেশপথ সংকীর্ণ, ভেতরে নানা স্থাপনা হয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করেছিলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তাঁদের সভা করার জন্য অনিরাপদ। নিরাপত্তার উদ্বেগটা তাঁদের মধ্যে বেশ প্রবল ছিল। নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে বিএনপির পক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা করার প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আশঙ্কাবোধ এমন একটি বিষয়, যেটিকে খুব সহজে উপশম করা যায় না। আবার কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে যেসব বিকল্প মাঠের নাম প্রস্তাব করা হচ্ছিল, পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছিল সেটা একধরনের রসিকতা।
বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্য পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। দলটির রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে?
মাহবুবউল্লাহ: বিএনপিকে এত দিন সংবাদপত্রের পাতায় রাজপথের বিরোধী দল বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এত দিন তারা রাজপথের বিরোধী দল ছিল না। সাম্প্রতিক বাস্তবতা থেকে মনে হচ্ছে, বিএনপি রাজপথকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। যেকোনো আন্দোলনের নানান ধরনের কৌশল থাকে। সংসদের ভেতরে একধরনের সংগ্রাম, সংসদের বাইরে আরেক ধরনের সংগ্রাম হয়। রাজনৈতিক সংগ্রামের আরেকটি দিক হলো, সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া। সেই সঙ্গে এটাও জানিয়ে দেওয়া যে প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। এটা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নির্বাচন কমিশন হোক আর অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হোক, সেগুলো যতক্ষণ নিজস্ব শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে না এবং ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে পারবে না, তত দিন পর্যন্ত আমাদের কপালে এ ধরনের দুর্ভোগ চলতেই থাকবে। বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্যের পদত্যাগ একটা প্রতীকী প্রতিবাদ, এর বেশি কিছু অর্থ এটা বহন করে না। তবে একটা বিষয় হলো, শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন রাজনীতিবিদেরাই। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত একভাবে না একভাবে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
সরকারি দল নির্বাচনের প্রচার শুরু করে দিয়েছে। নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপি পিছিয়ে পড়বে কি না?
মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপি পিছিয়ে পড়ছে, আমার কাছে সেটা মনে হয় না। আমরা যাঁরা বাইরে থেকে দেখি, তাঁদের কাছে মনে হয়েছিল বিএনপির ১০ তারিখের সমাবেশ বুঝি পণ্ড হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবে শান্তিপূর্ণভাবে ও চমৎকারভাবে সমাবেশটা হয়েছে। আমাদের দেশে দুটো বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দল হিসেবে তারা বড়, সম্পদও আছে এবং জনগণের সঙ্গে সংযোগও আছে। সে কারণে দল দুটি সিদ্ধান্ত নিলে নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য তাদের সময় দরকার হবে, সেটা আমার কাছে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসভাগুলোয় নির্বাচনের কথা বলেছেন, ভোট চেয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনের এখনো পুরো এক বছর বাকি। এত আগে থেকে ভোট চাওয়া থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে আগাম একটা নির্বাচন হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে অথবা সে ধরনের একটা বিষয় শাসক দলের চিন্তায় থাকতে পারে।
নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে অনৈক্য, সেটি কি নির্বাচন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে?
মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে শাসক দলের এবং বিরোধী দল ও তাদের মিত্রদের মধ্যে একটা বিরোধ আছে। সেটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হবে। এই অনিশ্চয়তা খুব খারাপ একটা বিষয়। শিল্পপতি হোন, ব্যবসায়ী হোন, শিক্ষক হোন, প্রশাসক হোন—অনিশ্চয়তা নিয়ে কেউ ষোলো আনা মনোযোগ দিয়ে তাঁর কাজটা করতে পারেন না। অনিশ্চয়তা সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য বিরাট ক্ষতিকর।
রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে নাগরিক সমাজের ভূমিকা কী হতে পারে বলে মনে করেন?
মাহবুবউল্লাহ: গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় যা দেখছি, তাতে মনে হয়েছে, আমাদের নাগরিক সমাজের ভূমিকা অনেক ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আশার কথা এই যে অনেকে কথা বলতে শুরু করেছেন। ফলে নাগরিক সমাজ থেকেও একটা রাজনৈতিক মাত্রা তৈরি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এটা হওয়ার জন্য বাংলাদেশের মতো দেশে খুব একটা বিরাট সময়ের প্রয়োজন হয় না। সেই দিক বিবেচনায় আমার আশা হলো, নাগরিক সমাজ সরকার ও জনগণের মাঝখানে একধরনের বিবেকের ভূমিকা পালন করতে পারেন।
নির্বাচন, বিরোধী দলের সভা–সমাবেশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিক ও উন্নয়ন সহযোগীরা উদ্বেগ জানাচ্ছেন। এ বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবউল্লাহ: প্রথম বিষয় হচ্ছে, আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা, অহংবোধ—এই সবকিছুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এগুলো কোনোভাবেই বিনষ্ট হোক, সেটা আমার কাছে পছন্দনীয় নয়। দ্বিতীয়ত, কিছু বিদেশি রাষ্ট্র, কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ—একটা ভূমিকা বাংলাদেশের ব্যাপারে গ্রহণ করছে। প্রশ্ন হলো, এই ভূমিকাটা বা তাদের বক্তব্য দেওয়ার মতো সুযোগ কারা সৃষ্টি করল। আমরা যদি একেবারে ত্রুটিমুক্ত হতে পারতাম বা ত্রুটিমুক্ত হওয়ার কাছাকাছি একটা অবস্থানে থাকতে পারতাম—তাহলে আমার মনে হয়, এ ধরনের হস্তক্ষেপ হতো না। একটা রাষ্ট্রের বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই দেশের ভেতরের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। দেশের ভেতরের অবস্থা যদি নড়বড়ে হয়, সরকারের ভূমিকা নিয়ে জনগণের মধ্যে যদি শঙ্কা থাকে, তাহলে এ ধরনের সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় একটা স্বার্থ আছে, সেটা হলো আমাদের অর্থনীতি। নানা কারণেই অর্থনীতির অবস্থা এখন নাজুক। এ পরিস্থিতিতে এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে আমাদের রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে করণীয় কী বলে মনে করছেন?
মাহবুবউল্লাহ: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি স্বাধীনতার ৫১ বছরেও পরিপক্বতা অর্জন করতে পারেনি। এটা এখনো কাঁচা ফলের মতো টক অবস্থায় রয়ে গেছে। এ পরিপক্বতা আমাদের রাজনীতিবিদেরা দেখাতে পারছেন না। এই পরিপক্বতা দেখানোর দায়িত্ব যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁদের চেয়ে যাঁরা সরকারে থাকেন, তাঁদের অনেক বেশি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবউল্লাহ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন