সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের সহিংসতা, অনিয়ম এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
প্রথম আলো: ইউপি নির্বাচনের পঞ্চম দফার ভোট গ্রহণ শেষ হলো গতকাল বুধবার। গতকাল সহিংসতায় ১০ জনের প্রাণ গেছে। এ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় ৮৬ জনের প্রাণ গেছে। এ সহিংসতা কেন?
বদিউল আলম মজুমদার: মূল কারণ হলো আমাদের নষ্ট রাজনীতি। আমাদের রাজনীতি আর জনকল্যাণের জন্য ও জনস্বার্থে নয়; এসব হলো ব্যক্তিস্বার্থে বা গোষ্ঠীস্বার্থে। রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণ হয়েছে। যারা রাজনীতিতে যুক্ত, তারা ফায়দা পাওয়ার জন্য রাজনীতি করে। যার ফলে প্রার্থীরা দলীয় পদ বা নির্বাচিত হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় যেতে চায়, আর ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম সম্পাদন করতে চায়। সবাই যে এমনটা করে তা নয়, কিন্তু উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশই এসবের সঙ্গে জড়িত। সবচেয়ে বড় কথা, বিচারহীনতার জন্য অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছে। সব কটি হয় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায়। তার মানে এসব পদপদবি পাওয়ার অর্থ হলো সোনার হরিণ পাওয়া। তাই যেকোনো মূল্যে তারা এসব পেতে চায়। যারাই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকবে, তখন তারা সুযোগ-সুবিধা যেমন পাবে, তেমনি অন্যায় করে পার পাওয়ারও সুযোগ থাকছে তাদের জন্য। অসুস্থ ও নষ্ট রাজনীতিই আমাদের বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো: এবারের নির্বাচনে সহিংসতা নিয়ে প্রথম ধাপের তুলনায় পরের ধাপগুলো নিয়ে আপনাদের মূল্যায়ন কী?
বদিউল আলম মজুমদার: সহিংসতা চতুর্থ ও পঞ্চম দফার নির্বাচনে কিছুটা কমেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ার যে তথ্য নির্বাচন কমিশন দেয়, তাতে কোনো নির্ভরযোগ্যতা নেই। নিজেদের নির্ভরযোগ্যতা না থাকার কারণে তাদের দেওয়া তথ্যেও ভরসা করা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে সহিংসতা কিছু কমেছে। কিন্তু এটা তো সমাধান নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা প্রশাসনকে কিনে ফেলার যে প্রবণতা দেখছি, সেগুলোর কোনো সমাধান হয়নি। এসবই রোগের লক্ষণ।
প্রথম আলো: এসব এতটা প্রবল হওয়ার কারণ কী? বিএনপির এবার নির্বাচনে না থাকা কোনো প্রভাব ফেলেছে কি?
বদিউল আলম মজুমদার: এখন শাসক দলের মনোনয়ন পাওয়ার অর্থ হলো প্রায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়া। শাসক দলের প্রতীক পেলে নির্বাচিত হওয়া প্রায় নিশ্চিত। প্রার্থীরা যে বিনিয়োগ করে, তা আরও নিশ্চিত করার জন্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে চায়। যারা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আছে, তাদের মাঠছাড়া করে কিংবা কিনে ফেলে, বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে তাদের নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এখন সমস্যা হলো প্রতীক পাওয়াটাও নিশ্চিত হচ্ছে না। এর কারণ মনোনয়ন–বাণিজ্যের প্রসার ও প্রভাব। যারা মনোনয়ন পাচ্ছে, তারা সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী নয়।
প্রথম আলো: অনেক জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব হয়েছে। আওয়ামী লীগের একাধিক বড় নেতার এলাকায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিপুল জয়ও দেখা গেছে। কী কারণে এমনটা হচ্ছে?
বদিউল আলম মজুমদার: যারা মনোনয়ন পাচ্ছে, তাদের বড় অংশ প্রতীক দ্বারা ক্ষমতায়িত। আর যে প্রতিপক্ষ বা বিদ্রোহী, সে কিন্তু নেতা-কর্মীদের দ্বারা ক্ষমতায়িত। নির্বাচনটা যে টাকার খেলায় পরিণত হয়ে গেছে, এটা যে কলুষিত হয়ে গেছে, যার কারণে যোগ্য ব্যক্তিরা আর মনোনয়ন পাচ্ছে না। আমরা ২০১৬ সালে নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলাম, দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে প্রার্থীদের সংখ্যা ও মান কমে গেছে। বড় নেতারা তাঁদের পছন্দের একক প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করার চেষ্টা করছেন। কোথাও পাহারা বসিয়ে অন্যদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে পাহারা বসিয়ে জোর করে প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেখানেই বিদ্রোহী প্রার্থীরা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো: বিএনপি যে মাঠ ছেড়ে দিল, সেটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হলো?
বদিউল আলম মজুমদার: তারা কেন এটা করেছে, বলতে পারব না। বিএনপির শাঁখের করাতের মতো দশা হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সমস্যার সমাধান করে না, আবার অংশ না নেওয়াও তাদের জন্য ইতিবাচক নয়। শাসক দল তাদের কেন্দ্রীয় কমান্ড হারিয়েছে এবারের নির্বাচনে বা তাদের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে সবাই ক্ষমতাসীন দলকে, নির্বাচন কমিশনকে ধিক্কার দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হলো। মাঠপর্যায়ে শত্রুতা সৃষ্টি হলো। এর সুযোগ বিরোধী পক্ষ তো নিতেই পারে।
প্রথম আলো: আগামী সাধারণ নির্বাচনে এই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রভাব কতটুকু পড়বে বলে আপনার মনে হয়?
বদিউল আলম মজুমদার: ২০১৫ সালে যখন সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করার সিদ্ধান্ত নিল, তখন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতমন্ত্রী আনিসুর রহমান এসেছিলেন। তখন আমাদের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করলেন। তারপরই সরকার বলল, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হবে। সেখানেই আনিসুর রহমান তাদের সাবধান করে বলেছিলেন, বুঝেশুনে করেন, যা করবেন। আমরা বলেছি, এর মাধ্যমে মারামারি বা হিংসা গ্রামাঞ্চলের বাড়ি বাড়ি ছড়াবে।
প্রথম আলো: পশ্চিমবঙ্গে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন তো দীর্ঘ সময় ধরে হয়ে আসছে। সহিংসতাও কম।
বদিউল আলম মজুমদার: এখন সহিংসতা কম, কারণ একদলীয় হয়ে গেছে। কিন্তু একসময় বামপন্থীরা তৃণমূলদের মারত। এখন তৃণমূল মারে। এখন তারা বামপন্থীদের মাঠছাড়া করেছে। এখন তৃণমূল এত শক্তিশালী যে অন্য কেউ মনোনয়নপত্রও জমা দিতে পারে না। যে আদর্শিক ভাবনা দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে করা হয়, তা হলো এর মাধ্যমে দলের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আমাদের এখানে উল্টো ঘটছে। দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দল কেন্দ্রে অগণতান্ত্রিক ও বিশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়, মাঠেও এর প্রভাব পড়েছে। দলের দায়বদ্ধতা, নীতি, আদর্শ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থাকবে বলে মনে করা হয়। কিন্তু আমাদের দলগুলো তো এসব ধারণ করে না। ইউপি নির্বাচনে দলের দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয়েছে। মনোনয়ন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হলে এমনটা হতো না।
প্রথম আলো: দলগুলো গণতান্ত্রিক না হওয়ার জন্যই কি এমন পরিস্থিতি?
বদিউল আলম মজুমদার: দলগুলো সিন্ডিকেটের মতো আচরণ করে। প্রতীকের নির্বাচন করতে হলে সে রকম দল গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় সরকারে দলীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় যে কেন্দ্রে সংসদীয় পদ্ধতি আছে, স্থানীয় সরকারেও হবে। এটা একেবারে অযৌক্তিক কথা। কারণ, তারা শুধু চেয়ারম্যান ও মেয়র পদে নির্বাচন প্রতীকে বা দলীয় ভিত্তিকে করছে, মেম্বার বা কাউন্সিলরদের নির্বাচন করছে না। ইউপিতে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন কোনো সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত ছিল না।
প্রথম আলো: এই বেসামাল অবস্থা কত দিন চলতে পারে?
বদিউল আলম মজুমদার: যত দিন পর্যন্ত স্বার্থপরতার রাজনীতি থাকবে, তত দিন এসব চলতে থাকবে। ন্যায়সংগত সুবিধা পাওয়া কোনো অন্যায় নয়। কিন্তু অন্যায্য সুবিধা, ক্ষমতার অপব্যবহার আর তা করে পার পেয়ে যাওয়া—এসবের অবসান না হলে এমনটা চলতেই থাকবে। তত দিন সহিংসতা ও বেসামাল অবস্থা বিরাজ করবে। জাতীয় পর্যায়েও এ ধরনের অবস্থা চলতে থাকলে কেউ ক্ষমতা ছাড়বে না। আর যারা বাইরে আছে, তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া। সবকিছু মিলিয়ে আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন