জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে নিয়ে সরকারি দলের এক সংসদ সদস্যের বিরূপ মন্তব্যের জেরে সংসদ অধিবেশনে সোমবার হট্টগোল হয়েছে ।
‘দশম সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে’ লালমনিরহাট-১ আসনের সরকারি দলের সংসদ সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের এমন বক্তব্যে জাতীয় পার্টির এমপিরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ সময় সংসদে হৈচৈ চিৎকার চেচামেচি শুরু হলে সংসদে কিছু সময়ের জন্য অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। সংসদে সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার সামসুল হক টুকু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিক সভাপতির চেয়ারে এসে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এ পর্যায় স্পিকার উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে তথ্যগত কোনো ত্রুটি থাকলে তা পর্যবেক্ষণ করে এক্সপাঞ্জ করার রুলিং দেন। চলতি একাদশ সংসদে এ ধরনের পরিস্থিতি আগে দেখা যায়নি।
সোমবার সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনার জন্য ফ্লোর পান মোতাহার হোসেন। তিনি বক্তব্যের শুরুতে বলেন, আমাকে ছয়বার সংসদে এবং দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ভোট করতে প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন। প্রথমবার ৫৫ হাজার ভোটে জিতেছি। গতবার জিতেছি ২ লাখ ৫৫ হাজার ভোটে। গত ভোটে (২০১৪) আমার স্ট্রং প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
‘মাত্র ৭ হাজার ভোট পেয়ে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল হাতিবান্ধা-পাটগ্রামে। আরও একবার আমি সংসদ সদস্য হতে পারতাম। আগের দিন আমি জিতেছি ২৭’শ ভোটে। পরেরদিন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আমাকে ২২’শ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন। তার ফলশ্রুতিতে গতবার আমার এলাকার ভোটার বুঝিয়ে দিয়েছেন তার অবস্থাটা কী?’মোতাহার হোসেনের বক্তব্যের শুরুতে জাতীয় পার্টির এমপিরা সংসদে ছিলেন না। তবে তার বক্তব্যের আট মিনিটের মাথায় ফিরোজ রশীদ দাঁড়িয়ে মাইক ছাড়াই কথা বলতে শুরু করেন। এ সময় মোতাহার হোসেন থেমে যান। কিছুক্ষণ পর সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার তাকে বসতে বলেন এবং পরে চাইলে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর দেবেন বলে জানান। তবে তাতে তিনি নিবৃত না হলে মাইক ছাড়াই কথা অব্যাহত রাখেন।
এ সময় মোতাহার হোসেন বলেন, আপনি সিনিয়র সংসদ সদস্য। আমার সময়ে আরেকজন বক্তব্য দেবেন কীভাবে? এ সময় ডেপুটি স্পিকার মোতাহার হোসেনের মাইকও বন্ধ করে দিয়ে বলেন, মোতাহার হোসেনকে দাঁড় করিয়ে রেখে কাজী ফিরোজ রশীদকে এক মিনিটের জন্য ফ্লোর দেন। তিনি এক মিনিটের মতো কথা বলেন। তার মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এ সময় ডেপুটি স্পিকার বলেন, আপনি পরে সময় নিয়ে যদি কোনো বক্তব্য থাকে বলবেন। ঠিক এ সময় বিরোধী দলের চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙা দাঁড়িয়ে মাইক ছাড়াই কথা বলতে শুরু করেন। ডেপুটি স্পিকার মোতাহার হোসেনকে একটু অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন, আমি রাঙা সাহেবকে একটু শুনি।রাঙা ফ্লোর পেলে সরকারি দলের সদস্যরা চিৎকার চেচামেচি শুরু করেন। তিনি ফ্লোর নিয়েই বলেন, চলে যাবো। চিৎকারের দরকার নেই আমরা চলে যাবো। পরে তিনি এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত ইস্যুর ব্যাখ্যা দেন।
এক পর্যায়ে তার মাইক বন্ধ হয়ে যায়। পরে ডেপুটি স্পিকার তাকে বসতে বলেন। জাতীয় পার্টির এমপিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা পয়েন্ট অব অর্ডারে কথা বলবেন। সময় দেওয়া হবে। আপনি বসুন। তার (মোতাহার হোসেন) বক্তব্য শেষ হোক। তবে ডেপুটি স্পিকারের কথায় কর্ণপাত না করে জাতীয় পার্টি এমপিরা চিৎকার করতে থাকেন। এ পর্যায়ে ডেপুটি স্পিকার বলেন, আপত্তিকর কিছু থাকলে তা এক্সপাঞ্জ করা হবে। আর পয়েন্ট অব অর্ডারে অন্য সুযোগে আপনি কথা বলবেন। আপনারা বসেন আমি পয়েন্ট অব অর্ডারে সুযোগ দেবো।
এই সময়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তড়িঘড়ি করে সংসদে প্রবেশ করে সভাপতির আসনে বসেন। এর আগে প্রায় ১০ মিনিটের মতো সংসদে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
স্পিকার হাউসে ঢুকে সবাইকে বসতে বলেন। বিরোধী দলের কাজী ফিরোজ রশীদ ও মসিউর রহমানের রাঙার নাম উল্লেখ করে বসতে বলে তিনি বলেন, হাউসের একটি ডেকোরাম আছে। এখানে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা হচ্ছে। এখানে একজন বক্তা তার বক্তব্য রাখছেন। সেই বক্তব্যে আপত্তিকর কিছু থাকলে সেটা আপনারা উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু এজন্য আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। উনি (মোতাহার) উনার বক্তব্য শেষ করবেন। আপনারা হাত তুলবেন। যদি এমন কোনো বিষয় থাকে যেটা এক্সপাঞ্জ করার প্রয়োজনীয়তা আছে সেটা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুযোগ আছে।
মোতাহার হোসেনকে দেওয়া ১০ মিনিট শেষ হলে স্পিকার তাতে আরও ১/২ মিনিট কথা বলার জন্য ফ্লোর দেন। ফ্লোর পেয়ে তিনি এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত বিষয়ে আগের বক্তব্য ডিপেন্ড করে ফের বলেন, উনারা (জাপা) যে প্রশ্নটি তুলেছেন- ১৯৮৫ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। সেবারও উনাদের ক্যান্ডিডেটের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
নব্বইয়ে আমি আবারও উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াই। তখনও উনাদের ক্যান্ডিডেটের জামানত আমি বাজেয়াপ্ত করি এবং শেষবার ভোটে। উনারা সবাই ছিলো, রাঙাও ছিলো। ওই বরিশালের রুহুল আমিন হাওলাদার ছিলেন এবং এরশাদ সাহেবের ভাইও ছিলেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে আমাকে এরশাদ সাহেবই প্রশ্নটা তুলেছিলেন তুমি আমার জামানত বাজেয়াপ্ত করে দিলে।
আমি বলেছিলাম আগেও দু’বার করেছি। এবারও করলাম। আমি তো এখানে সত্য, মিথ্যা কথা বলিনি। এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। আর আমি বক্তব্য দিচ্ছি সেখানে উনারা মাঝখানে বক্তব্য দেবেন। এটা কোনোভাবে হতে পারে না। আমি খুব কষ্ট পাইলাম। এখানে অবশ্যই তাদের ডেকোরাম মানতে হবে। স্পিকার তাকে অবশিষ্ট বক্তব্য শেষ করার অনুরোধ করেন। এ সময় জাতীয় পার্টির এমপিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার সময়টা উনারা নষ্ট করেছেন। আমার তিন মিনিট সময় নষ্ট করেছেন। জবাবে স্পিকার বলেন, আপনাকে এক মিনিটে শেষ করতে বলেছি। এক মিনিটে শেষ করবেন।
এরপর মসিউর রহমান রাঙাকে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর দেন স্পিকার। তিনি বলেন ,আমরা মাগরিবের নামাজের পর বাইরে ছিলাম। ওখান থেকে আমরা শুনলাম উনি বলছিলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত করে আমি এই সংসদে এসেছি।
লালমনিরহাট-১ আসনে এরশাদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে রাঙা বলেন, আমাকে এরশাদ সাহেব বললেন তুমি লালমনিরহাটে গিয়ে আমারটা (মনোনয়নপত্র) সাবমিট করে দিয়ে আসো। আমি সাবমিট করতে গিয়ে দেখলাম উনার (মোতাহার) লোকজন সব। আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তবুও আমি জমা দেই।
এ সময় স্পিকার জানতে চান তিনি কোন সালের কথা বলেন জবাবে বলেন, এটা ২০১৪ সালের ঘটনা। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে পরাজিত করে উনি সংসদে এসেছেন এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। আপনি এটা এক্সপাঞ্জ করে দেবেন।
পরে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফিরোজ রশীদ বলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি আমাদের মাঝে নেই। একজন মৃত ব্যক্তির নামে এ ধরনের কুৎসা রটনা উচিত নয়। মোতাহার সাহেবের ভালো করে জানা উচিত এরশাদ সাহেব রংপুরের মাটিতে কোনো দিনও হারেননি। তিনি কারাগারে থেকে ৫টি আসনে জয়লাভ করেছেন। ২২টি আসনে একা প্রার্থী হলে সবগুলোতে জয়ী হতেন। তিনি কারাগারে থেকে দুইবার ৫টি করে আসনে জয়ী হয়েছেন।
মোতাহার হোসেনকে উদ্দেশ্য করে ফিরোজ রশীদ বলেন, উনি এতবড় বীর বিক্রম হয়ে গেলো? এরশাদ সাহেবের জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। যে নির্বাচনে এরশাদ সাহেব দাঁড়ায়ইনি। তার কোনো প্রার্থীকে দাঁড়াতে দেননি। আমাকে দিয়ে উইড্রো করালেন পরে আমি দাঁঁড়িয়েছি। এটা সম্পূর্ণ এক্সপাঞ্জ চাই। আমাদের দাবি এটা এক্সপাঞ্জ করবেন। না হলে রংপুরের মাটিতে তার অসুবিধা হবে।
পরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ ইস্যুতে রুলিং দেন। তিনি বলেন, মাননীয় সদস্য মোতাহার হোসেনের বক্তব্যে যদি কোনো তথ্যগত ত্রুটি থাকে থেকে থাকে তাহলে সেটা বিবেচনা করে তা পরীক্ষা করে এক্সপাঞ্জ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।