Image description

মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় (নোম্যান্স ল্যান্ডে) সশস্ত্র সংগঠন ‘আরসা’ ও ‘আরএসও’র মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখায় এ দুটি সশস্ত্র সংগঠনের ঘাঁটি স্থাপন করা এবং সেটা নিয়ে দুই পক্ষের তীব্র গোলাগুলিতে সীমান্ত এলাকায় নতুন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। 

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) নামে রাখাইনের আঞ্চলিক এ দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণে এখন সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সংঘর্ষের জেরে অনেক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বিভিন্ন গ্রুপে-উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক ও স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভরযোগ্য একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শূন্যরেখায় মিয়ানমার সীমানায় আরসার বিশাল সুড়ঙ্গ বা ঘাঁটি ছিল বলে বিভিন্ন ‘সোর্স’ থেকে জানা যায়। সেই ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ আরএসও। ঘাঁটিটি এখন আরএসওর দখলে বলে শোনা যাচ্ছে। সুড়ঙ্গ বললেও এটি মূলত মাটির নিচে তৈরি পাকা ঘর। অনেকটা মাটির নিচে বাঙ্কারের মতো বলেও তথ্য পাওয়া যায়। যেহেতু সীমানাটি মিয়ানমারের ভূখণ্ডে তাই সেখানে বাংলাদেশের কোনো সংস্থার পৌঁছানোর সুযোগ নেই। 

তবে বাংলাদেশ সীমানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশসহ (বিজিবি) অন্যান্য বাহিনী সার্বক্ষণিক ওই এলাকায় সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। ওই কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, মূলত এ সুড়ঙ্গ বা ঘাঁটি আরসার গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। এটি শূন্যরেখায় মিয়ানমারের ভূখণ্ডে পড়েছে। আরসার এ ঘাঁটি বাংলাদেশে মাদক পাচারেরও মূল আস্তানা হিসেবেও ব্যবহার হয়েছে। এটাকে মাদক পাচারের সবচেয়ে বড় রুটও বলা যায়। এখান থেকে মাদক চোরাচালানের ‘বখরা’ হিসেবেই আরসা মাসে কয়েক কোটি টাকা পেয়েছে বলে জানা যায়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৮ জানুয়ারি তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশে আরসা ও আরএসও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তীব্র গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওই সময় নোম্যান্স ল্যান্ডে ঠাঁই নেওয়া শত শত রোহিঙ্গাদের বসতি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকে কয়েক দফায় সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ পান স্থানীয়রা। গত দুয়েক দিনের মধ্যে তেমন সংঘর্ষের খবর পাওয়া না গেলেও সীমান্তের ওই এলাকার পরিস্থিতি অনেকটা থমথমে। বিশেষ করে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তবর্তী বাংলাদেশিরা উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় পার করছেন। এ ছাড়া এই সংঘর্ষের প্রভাব পড়েছে উখিয়ার বেশিরভাগ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। কেননা আরসা ও আরএসওর অনেক সদস্য বিভিন্ন কৌশলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং মিয়ানমারে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকে বলেও অভিযোগ আছে। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্দেহের জায়গাটি বড় হয়েছে। পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর অভিযান ও নজরদারিও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এরই মধ্যে গত শনিবার রাতে উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে আরসা কমান্ডারসহ পাঁচজন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এ প্রসঙ্গে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ মোবাইল ফোনে সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমানে ধুমধুম সীমান্তে তেমন আর উত্তেজনা নেই। কয়েক দিন আগে খুব খারাপ পরিস্থিতি ছিল। যদিও সেই গোলাগুলি ও আগুনের ঘটনা সীমান্তের শূন্যরেখায় মিয়ানমারের অংশে ঘটেছিল। কিন্তু সেটার ভয়ানক প্রভাব পড়ে বান্দরবানের এ সীমান্ত এলাকাতেও। এখন শূন্যরেখায় অনেক রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। সেটার কী হবে তা এখন সরকারের সিদ্ধান্ত। এটা নিয়ে আমরা সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দারা বেশ বিপদে আছি।

সীমান্তের ওই পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ সময়ের আলোকে বলেন, সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে এটি প্রভাব সৃষ্টি করবে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যে পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন সেটি তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। এ মুহূর্তে পর্যবেক্ষণে যেটি দেখা যাচ্ছে তা হলো মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে কে কোন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে সেটা নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। তাদের সরকারের সমর্থনও ক্রমান্বয়ে কমছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, এটার জন্য রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের যতক্ষণ না পর্যন্ত স্বীকৃতি দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই জাতিগত সংঘাত তারা অভ্যন্তরীণভাবে নিরসন করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের (বাংলাদেশ) জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুটি খুব বড় বিষয়। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। তাই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে আরও সক্রিয় করা জরুরি। এ মুহূর্তে একটি ভালো সময় বিরাজ করছে, মিয়ানমার সরকার এখন অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। সেই দুর্বলতার মধ্যে যদি আন্তর্জাতিক চাপটা বাড়ে তাহলে মিয়ানমারকে একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসতেই হবে।

তুমব্রু সীমান্তের ওপারে সুড়ঙ্গ প্রসঙ্গে স্থানীয় ঘুমধুম ইউপির চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ সময়ের আলোকে বলেন, ওই সুড়ঙ্গগুলো শূন্যরেখায় মিয়ানমারের মধ্যে। আন্তর্জাতিক সীমানা হওয়ায় সরাসরি সেখানে আমরা কেউ যেতে পারিনি। তবে স্থানীয়ভাবে ও বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে জেনেছি, সুড়ঙ্গের নিচে পাকা ঘর, হোটেলসহ নানা রকম ব্যবস্থা ছিল। সেখান থেকে আরসা তাদের সংগঠনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিল বলে শোনা যায়। 

তিনি আরও বলেন, আরসা ও আরএসওর মধ্যে সংঘাত এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছোট ছোট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতার কারণে আমরা স্থানীয় জনগণ খুব সমস্যায় আছি। নিরাপত্তার বিষয়টি প্রতিনিয়তই বড় হুমকি হয়ে উঠছে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও জটিল হচ্ছে। এমনিতেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিতে চাইছে না। তার মধ্যে আবার রোহিঙ্গাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত পরিস্থিতি আরও জটিল করছে, যা সারা দেশের মানুষই বুঝতে পারছে। এ প্রসঙ্গে বিজিবির সদর দফতর ও স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে তাদের সরকারি মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলেও কেউ রিসিভ করেননি।

আরএসওর ১৮ জনকে হত্যার দাবি আরসাপ্রধানের! : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সীমান্তের তুমব্রুর শূন্যরেখা এলাকায় গত ১৮ জানুয়ারি আরএসও ও আরসার মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন আরসা কমান্ডার ইন চিফ আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি। গত ২৮ জানুয়ারি সকাল ৮টার দিকে ‘সৈয়দ নুর আরাকানী’ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে ভিডিও প্রকাশ করে জুনুনি দাবি করেন, ‘১৮ জানুয়ারির ওই সংঘর্ষে আরএসওর ১৮ জনের বেশি সদস্য নিহত হয়েছেন। তবে এ সময় আরসার একজন সদস্যও নিহত হয়নি।’ 

আরসাপ্রধান আরও বলেন, ‘আরএসও সদস্যরা রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করবে সেটা আগে থেকে পরিকল্পনা করে আসছিল। যেটি আমরা বুঝতে পারিনি। তাদের কাছে ভারী অস্ত্র ছিল যেটি আমাদের কাছে ছিল না। তবে তা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে আমার দলের সদস্যরা কৌশলে সারা দিন যুদ্ধ করে। যেটিতে আমরা আলহামদুলিল্লাহ সফল হয়েছি।’

জানা যায়, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি আগে ইংরেজিতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তাদের তৎপরতা চালাত। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে। পরে তৈরি হয় আরএসও নামেও আরেকটি সশস্ত্র গ্রুপ।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘আরসা’ কমান্ডারসহ গ্রেফতার ৫:  উখিয়া প্রতিনিধি কায়সার হামিদ মানিক জানান, কক্সবাজারের উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে আরসা কমান্ডারসহ পাঁচজন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। 

গত ২৯ জানুয়ারি রাতে এ তথ্য জানিয়ে র‌্যাব-১৫-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সিনিয়র সহকারী পরিচালক) আবু সালাম চৌধুরী বলেছেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার রাতে উখিয়া বাজারে আরসার আহত সদস্যদের জন্য ওষুধ সংগ্রহ করতে এলে অভিযান চালায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও র‌্যাবের দল। 

এ সময় পুলিশ ও র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করলে ধাওয়া করে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন- আরসা কমান্ডার ডা. রফিক (৫৪), সদস্য মোহাম্মদ রফিক (২০), নুরুল আমিন (৩৪), মোহাম্মদ রফিক (২১) খায়রুল আমিন (৩২)। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক ও পুলিশ লাঞ্ছিতসহ একাধিক মামলা রয়েছে।