Image description

জাহেদ উর রহমান। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল্যায়ন, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম  রাফসান গালিব  

প্রথম আলো

একটা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে অন্তর্বতী সরকার। ছয় মাস পর এসে কি মনে হচ্ছে সরকারের জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়েছে?

জাহেদ উর রহমান: হ্যাঁ, সরকারের জনসমর্থনে ভাটার টান আমি লক্ষ করছি। এই অল্প সময়ের মধ্যে সরকারের আসলে অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমরা দেখতে চেয়েছি, সরকার চেষ্টা করছে এবং ব্যবস্থা নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে তারা হয়তো সফল হতো না। কিন্তু আমি দেখছি তারা আসলে অ্যাকশনই ঠিকমতো নিচ্ছে না।

মানুষকে এখনো আড়াই শ-তিন শ টাকা বাঁচানোর জন্য কয়েক ঘণ্টা টিসিবি ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। তাঁদের কাছে সংস্কার, পরিবর্তন এসব বিষয় আর গুরুত্বপূর্ণ থাকছে না। তাঁরা দেখছেন, জিনিসপত্রের দাম ঠিক থাকছে না, ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি নেই। একেকজন একেক কারণে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের জনসমর্থনে ভাটার টান হচ্ছে।

আমার মনে হচ্ছে, সরকার আসলে সবার কাছে জনপ্রিয় হতে চাইছে। একটা সরকার কিন্তু কোনো দিনও সবার কাছে জনপ্রিয় হতে পারে না। সরকার মানে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা প্রশাসক। সে যখন কোনো পদক্ষেপ নেবে, তখন কিছু মানুষ নাখোশ হবে, কিছু মানুষ খুশি হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে সরকার হিসেবে অ্যাক্ট (কাজ) করছে না। মানছি, সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এত রক্ত দিয়ে যেহেতু এ সরকার আমরা অর্জন করেছি, ফলে এমন প্রত্যাশার চাপ থাকবেই। এখন সেই চাপ সামাল দিতে না পারাও সরকারের জনপ্রিয়তা কমার একটা বড় কারণ।

প্রথম আলো

সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বা আমলারা নানাভাবে সরকারের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে—এমন আলোচনাও আছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী? 

জাহেদ উর রহমান: আমলাতন্ত্রের কথা প্রধান উপদেষ্টা নিজেও বলেছেন। এটা পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট (রাজনৈতিক সরকার) নয়, কিন্তু এই সরকার তো জলে ভেসে আসেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম জনসমর্থন আর কোনো সরকারের ছিল না। সেনাবাহিনীও চমৎকারভাবে সমর্থন বজায় রেখেছে। এই সবকিছুর পরও যদি সরকার আমলাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারে, সেটা পুরোপুরি সরকারের ব্যর্থতা বলে আমি মনে করি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য নিয়ে তারা যা করেছে, তা চাকরিবিধি ও শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এরপর কি সরকার কোনো দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে? 

প্রথম আলো

শুরুতে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হলেও সংবিধান বাতিল, জুলাই ঘোষণাপত্র—এ বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মতভিন্নতা দৃশ্যমান হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের একধরনের দূরত্ব রয়েছে, এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। আপনি কী মনে করেন?

জাহেদ উর রহমান: মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার পতনের আগে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এক দফায় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের কথা বলা হলেও মানুষ একত্র হয়েছিল হাসিনার পতনের জন্য। তাঁর পতনের পর একেকজনের একেক রকম এজেন্ডা তৈরি হয়েছে। যে রাজনৈতিক দলের ভোটে জেতার সম্ভাবনা আছে, তারা মনে করল, দ্রুত নির্বাচন হলে তারা দ্রুত ক্ষমতায় যাবে। এ কারণেই প্রথম দিকে বিএনপি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছিল।

অন্যদিকে ছাত্রদের একধরনের চিন্তা আছে। ছাত্রদের পেছনে বা ছাত্রদের ওপর প্রভাব আছে, এমন মানুষজনেরও কিছু পরিকল্পনা আছে। তারা অন্য কোনো পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করেছে। তার প্রভাবই এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজনীতিতে। চব্বিশের জুলাই-আগস্টে যা হয়েছে, তা কোনোভাবেই বিপ্লব ছিল না, এটা একটা গণ-অভ্যুত্থান ছিল। অনেকেই গণ-অভ্যুত্থানকে ‘বিপ্লব’ বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন। এর ফলে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটাও অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে আমি মনে করি।

প্রথম আলো

ছাত্রদের উদ্যোগে দল গঠন এবং এর প্রক্রিয়া নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানা রকম খবর আসছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

জাহেদ উর রহমান: বলতেই হবে যে গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্ররাই ছিল মূল শক্তি বা নেতৃত্ব। তবে যে বয়সে এবং যে প্রক্রিয়ায় লড়াই করে একটা সরকারের পতন ঘটানো যায়, একইভাবে একটা দল তৈরি করা যায় কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

ছাত্রদের প্রধান মনোযোগের জায়গায় রেখে কিছু ম্যাচিউরড মানুষ নিয়ে দল তৈরি হলে সবচেয়ে ভালো হতো। আরেকটি বিষয়, ছাত্ররা যখন উপদেষ্টা পরিষদে গেলেন, আমার কাছে সেটা ইতিবাচক মনে হয়নি। অনেকেই এখন তাদের সম্ভাব্য দলকে ‘কিংস পার্টি’ বলছে। এটা বলার মতো যুক্তিসংগত কারণও আছে। ছাত্র উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক কমিটির বক্তব্যে অনেক সময়
আমরা মিল খুঁজে পাই। সরকারের বিভিন্ন কাজে তাদের প্রভাব রয়েছে—মানুষের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে।

কিংস পার্টির আলাপে এই আলোচনাও ওঠে, বিএনপিও তো কিংস পার্টি। তাহলে সমস্যা কী? হ্যাঁ, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থেকেই বিএনপি তৈরি করেছেন। কিন্তু সেটা ছিল ঘোষিত বা খোলামেলা একটা প্রক্রিয়া। কিন্তু ছাত্রদের উদ্যোগের ক্ষেত্রে একধরনের অস্পষ্টতা বা লুকোছাপা লক্ষ করা যাচ্ছে, যেটা জনগণ বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করছে না বলেই মনে হচ্ছে।

 
প্রথম আলো

বেশ কিছুদিন ধরে বিএনপি-জামায়াতের বিরোধ রাজনীতির একটা অন্যতম আলোচিত বিষয়। এই বিরোধ কেন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটা কোন দিকে যেতে পারে বলে মনে হয়?

জাহেদ উর রহমান: এই বিরোধ কিছুটা রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক, বেশির ভাগটাই ভোটের হিসাবের বিবেচনায়। একসময় বিএনপি-জামায়াত একই সঙ্গে আন্দোলন করেছে, এর আগে জোট সরকারও গঠন করেছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দল দুটির মধ্যে যা হচ্ছে, সেটা স্বাভাবিক।

শেষের ১০ বছর আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, এটা ছিল একটা মাফিয়া গ্যাং। যত দিন পর্যন্ত পার্টি হিসেবে ছিল, দলটি মধ্যপন্থী ও মধ্য বামপন্থী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ নেই, নতুনভাবে রাজনীতির মেরুকরণ হচ্ছে। বিএনপি যে মধ্যপন্থী রাজনীতি শুরু করেছিল, সেটা কিছুটা ডানপন্থার দিকে ছিল। এখন তারা মধ্যপন্থায় থাকতে চাইছে, মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে আগের চেয়ে উচ্চকিত হচ্ছে।

অন্যদিকে জামায়াত তার নিজস্ব রাজনীতি সামনে আনছে। জামায়াত অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে একত্র হওয়ার চেষ্টা করছে। এ রকম অবস্থায় বিএনপি এখন সম্ভব হলে কিছুটা মধ্য বামপন্থার দিকেও যেতে পারে। এর ফলে দল দুটির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য বলে মনে করি।

প্রথম আলো

ন্যূনতম কিছু সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে বিএনপি। অন্যদিকে ছাত্রদের প্ল্যাটফর্মগুলো বিএনপির এ অবস্থান নিয়ে সমালোচনা করেছে। এ মতভিন্নতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

জাহেদ উর রহমান: নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলো আসলে তাদের সুবিধার জায়গা থেকে কথা বলছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি বা ছাত্রদের দল গোছানোর জন্য সময় প্রয়োজন। এ কারণে নির্বাচন দেরিতে হলে তাদের সুবিধা হবে। কিন্তু বিএনপির তৃণমূল পর্যন্ত দল গোছানো আছে। তারা যেকোনো সময় নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত। 

এ কারণেই নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একধরনের বাগ্‌বিতণ্ডা হচ্ছে। কোনো একটি পক্ষ তাদের মতো করে কিছু চাইলেই তা হবে না। সরকারের কাছ থেকে কে কতটুকু কী অর্জন করতে পারবে, তা আসলে নির্ভর করছে, মাঠে কার কতটুকু শক্তি আছে, তার ওপর।

নির্বাচন নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস একটি সময়সীমার কথা বলেছেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশে যত দ্রুত সম্ভব একটা নির্বাচিত সরকার আসা উচিত। এই বছরের মধ্যে নির্বাচনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটিই আমার কাছে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

প্রথম আলো

তাহলে সংস্কারের কী হবে?

জাহেদ উর রহমান: নির্বাচনের আগে ও পরে—দুই ক্ষেত্রেই সংস্কার করতে হবে। সরকার কমিশনের প্রতিবেদনগুলোকে দুভাগে ভাগ করতে পারে; কিছু বিষয়ের জন্য হচ্ছে সংবিধান সংস্কার করতে হবে আর কিছু বিষয়ের জন্য আইন, বিধিমালা, ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করতে হবে। আইন করার জন্য সংসদ লাগে। এখন যেহেতু সংসদ নেই, অধ্যাদেশ দিয়ে আইন করতে হবে। আর যে বিষয়গুলোর জন্য সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে, সেগুলো ভবিষ্যতের জন্য রাখতেই হবে।

কিছু অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। আমি নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ছিলাম। সেই জায়গা থেকে একটি উদাহরণ দিই। আমাদের সংসদ নির্বাচন যে আইন দিয়ে হয়, তা হলো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকগুলো সংশোধনীকে প্রস্তাব আকারে দিতে পারি।

ধরে নিলাম, পাঁচটা বিষয়ে সবাই একমত হলো। এই পাঁচটা বিষয় আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং সেকশনে পাঠাতে হবে। সেগুলো ঠিকঠাক করে তা উপদেষ্টা পরিষদে পাঠাতে হবে। সেখানে একদিন আলোচনা করে অধ্যাদেশ জারির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। সব পক্ষের মতামত নিয়ে ছয়টা কমিশনের প্রস্তাবিত আইনগত পরিবর্তনগুলো এভাবে করা যায়। যদি এক মাস ইনটেনসিভ (ব্যাপক) আলাপ-আলোচনা করা হয়, তাহলে পরবর্তী এক-দুই মাসের মধ্যেই এ সংস্কারগুলো করা সম্ভব।

প্রথম আলো

অভ্যুত্থানের সময় ঘটা হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আবার শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে এখন ভারতের আশ্রয়ে কিংবা আনুকূল্যে আছেন। শেখ হাসিনাকে কি ভারত ফেরত দেবে?

জাহেদ উর রহমান: শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে এখনো বিচারকাজ শুরু হয়নি, তদন্ত চলছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে চাওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনাকে হয়তো তারা ফেরত দেবে না। সরকারের উচিত অন্য নেতাদেরও ফেরত চাওয়া। আমি মনে করি, সরকার যদি যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে থাকে, তাহলে অন্য কিছু নেতাকে ভারত ফেরত দিতেও পারে।

একটা কথা বলে রাখা ভালো যে বিচারপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে। এমন কারও কারও বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হতে পারত। এই সরকার আসার পর খুব দ্রুত দুদক পুনর্গঠন করা দরকার ছিল। অথচ এটা অনেক পরে হয়েছে।

প্রথম আলো

মাজারে ভাঙচুর, নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। সরকারের তরফ থেকে এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন?

জাহেদ উর রহমান: সরকার হয়তো মেজরিটি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে জনপ্রিয় থাকতে চাইছে। সরকারের কাজ কিন্তু মেজরিটির কাছে জনপ্রিয় থাকা নয়। সরকারের কাজ হচ্ছে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আমি ধারণা করি, যারা এসব ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকার হয়তো ঝুঁকি বোধ করছে। সরকার যদি প্রথম থেকেই কঠোর পদক্ষেপ নিত, তাহলে এ ঘটনাগুলো ঘটত না।

আমরা দেখছি শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের দিক থেকে একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে। সেটা হলো, বাংলাদেশ উগ্র ইসলামপন্থার দিকে চলে গেছে। এসব ঘটনায় ভারতের সেই ন্যারেটিভই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তাই এ ধরনের ঘটনার পেছনে কারা রয়েছে, তা খুঁজে বের করা দরকার।

প্রথম আলো

পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী শব্দযুক্ত একটি গ্রাফিতি বাদ দেওয়া নিয়ে পাল্টাপাল্টি প্রতিবাদ এবং এক পক্ষের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে কি তাহলে আইডেনটিটি পলিটিকস বা পরিচয়বাদী রাজনীতি আগের চেয়ে জোরদার হয়ে উঠছে?

জাহেদ উর রহমান: রাজনীতিকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা পরিচয়বাদী, আরেকটা জনকল্যাণভিত্তিক। পরিচয়বাদী রাজনীতি মানুষ ও সমাজকে বিভক্ত করে। অন্যদিকে জনকল্যাণভিত্তিক রাজনীতি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতির চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে পরিচয়বাহী রাজনীতিটা মাথাচাড়া দিচ্ছে। অনেকেই পরিচয়বাদী সিম্বল বা প্রতীক সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এই রাজনীতি দিয়ে জনগণের কোনো উপকার হবে না।

প্রথম আলো

বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েনকে কীভাবে দেখছেন? দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে?

জাহেদ উর রহমান: ভূরাজনীতিতে মূল কথা আছে, বন্ধু পাল্টানো যায়, কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। এটা আমাদের দিক থেকে যেমন সত্য, তাদের দিক থেকেও সত্য। কিন্তু ভারত কখনো এই বিষয়টিকে সমর্থন করেছে বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনার পতনের পর তারা বিষয়টিকে যেভাবে ডিল করার চেষ্টা করেছে, এটা ভুল করছে।

ভারত আসলে আমাদের সঙ্গে খুব বেশি দিন শত্রুতা বা নেতিবাচক সম্পর্ক চালিয়ে নিতে পারবে না। এর দুটি কারণ। একটা হচ্ছে অর্থনৈতিক। তারা প্রচুর পণ্য আমাদের এখানে রপ্তানি করে। চিকিৎসার জন্য, পর্যটন ও কেনাকাটা করতে আমাদের প্রচুর মানুষ যান সেখানে। এগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে এখন রোগী কমে গেছে, হোটেল, মার্কেট ও রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ধস নেমেছে।

আরেকটা দিক কৌশলগত। ভারত বাংলাদেশকে এভাবে ডিল করতে থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ তখন অন্য জায়গায় তার মিত্র খোঁজার চেষ্টা করবে। যেমন আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কদিন আগে বললেন, সরকার চীনের সঙ্গে কথা বলেছে, কুনমিংয়ে চার-পাঁচটা হাসপাতাল যেন বাংলাদেশিদের জন্য ডেডিকেটেড করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগ বাড়ছে। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে আমাদের এই সম্পর্ক তৈরি নিয়ে ভারতের মিডিয়াগুলোও বেশ শোরগোল করছে। অথচ বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার কারণে ভারতীয় থিঙ্কট্যাংকের লোকজন আগে বলত, শেখ হাসিনাকে খুব বেশি চাপ দিলে বাংলাদেশ চীনের দিকে চলে যাবে।

আর সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারতের বাড়াবাড়ি পর্যায়ের নাক গলানোর বিষয়ের মূলে আছে ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। ওই নির্বাচন পর্যন্ত বিজেপি আসলে এটি করে যাবে। যার কারণে ইসকন ও চিন্ময় ইস্যুতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। তিনি বাংলাদেশে জাতিসংঘ বাহিনী পাঠানোর কথা বলেছিলেন। ওই নির্বাচনের পর হয়তো আমরা একটা স্থিতিশীল সম্পর্কের দিকে যাব।

বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন চাওয়ার বিষয়টি তাদের দিক থেকে ঠিকই আছে। কারণ, শেখ হাসিনা পতনের পর তাঁরা অধ্যাপক ইউনূস সরকারের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। আমরা নানা ইস্যুতে সরকারের অনেক সমালোচনা করলেও অধ্যাপক ইউনূস এখানে অসাধারণ কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে একটি জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন। তিনি ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পেরেছেন।

প্রথম আলো

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় আওয়ামী লীগ কি কোনো আশার আলো দেখতে পেয়েছে?

জাহেদ উর রহমান: বিষয়টিকে ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার সঙ্গে তুলনা করা যায়। কথা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের বড় সমর্থন ছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশ কতটা গুরুত্ব পায়, সেটিও দেখার বিষয়। তবে চীনের কারণে বাংলাদেশ তার কাছে গুরুত্বপূর্ণও হয়ে উঠতে পারে। এটি ঠিক, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আগের মতো না থাকলে সরকার কিছু ক্ষেত্রে সংকটে পড়তে পারে।

আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, হঠাৎ করে এমন পতনের বিষয়টি তারা এখনো মেনে নিতে পারছে না। কারণ, তারা ধরেই নিয়েছিল কমপক্ষে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। এখন কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি না দিয়ে তারা প্রাসঙ্গিক থাকতে চাইছে। কিন্তু তারা কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।

প্রথম আলো

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

জাহেদ উর রহমান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।