সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং পরে এবি পার্টির প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর দেশ ছেড়ে যাওয়া ও ফিরে আসা, বিচার বিভাগের ভূমিকা, বিএনপি-জামায়াতের বিরোধসহ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচন এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম
আবদুর রাজ্জাক: আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমে আমাকে পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করেছিল। সৌভাগ্যবশত তখন বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল। তাই সরকার আমার পাসপোর্ট জব্দ করার চেষ্টা করেও পারেনি এবং আমি আগাম জামিনও পেয়েছিলাম। এরপর আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। তখন থেকে প্রায় ২৪ ঘণ্টা আমি পুলিশের নজরদারিতে ছিলাম। আদালত, চেম্বার, বাসা, এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানেও পুলিশ আমার ওপর নজরদারি করত। এভাবে আমি হয়রানির শিকার হতে থাকি। তবে তখন পর্যন্ত আমাকে গ্রেপ্তার করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হলো ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে। চারদিকে একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করেছে। সরকার একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একদিন খবর এল, আমার বাসায় থাকাটা ঠিক হবে না; যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারি। আমি দুই রাত বাসার বাইরে ছিলাম। তখন আদালত বন্ধ থাকায় আমার তেমন কোনো কাজ ছিল না। আমি চিন্তা করলাম, এই সুযোগে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য লন্ডন থেকে ঘুরে আসি। ১৭ ডিসেম্বর আমি লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম। ১৮ ডিসেম্বর ভোরে আমি লন্ডন পৌঁছালাম। ওই দিনই আমি জানতে পারলাম, আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমি নাকি ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় পুলিশের ওপর বোমা মেরেছি। ওই দিন বা তার পরের দিনই পুলিশ আমার বাসায় এসেছিল।
এরপর একটা রাজনৈতিক সূত্র এবং অন্যটি কূটনৈতিক সূত্র, দুইটা সূত্র থেকেই জানতে পারলাম, আমাকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেছিলেন, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তারের জন্য নেত্রী (শেখ হাসিনা) তাঁদের ‘ক্লিয়ারেন্স’ দিয়েছেন। কূটনৈতিক সূত্র থেকেও একই রকম খবর জানতে পারলাম। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার বন্ধুবান্ধব দেশে না ফেরার পরামর্শ দেন। এ কারণে আমার দেশে ফেরা হয়নি; গিয়েছিলাম দুই সপ্তাহের জন্য, থাকতে হলো ১১ বছর।
সম্প্রতি একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপনি বলেছেন, জুডিশিয়ারি বা বিচার বিভাগ রক্ষা করতে পারলে অনেককে দেশ ছাড়তে হতো না। বিচার বিভাগ নিয়ে আপনার এই মন্তব্যের কারণ কী?
আবদুর রাজ্জাক: বিচার বিভাগ হচ্ছে রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সভ্য দেশের একটা মাপকাঠি হচ্ছে তাদের বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেছিল, তখন কিছু হস্তক্ষেপ করলেও বিচার বিভাগ মোটামুটি স্বাধীন ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেশির ভাগ সময়ই বিচার বিভাগের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। বিচার বিভাগ ছিল পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের অধীন। আইনে কী আছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ওপর থেকে যে নির্দেশনা আসত, সে অনুযায়ী আদালত সিদ্ধান্ত জানাতেন। দেশে যদি আইনের শাসন ৫০-৬০ শতাংশও থাকত, আমি নিশ্চিত যে অনেককেই দেশের বাইরে যেতে হতো না, আমাকেও ১১ বছর দেশের বাইরে থাকতে হতো না।
বিচার বিভাগের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
আবদুর রাজ্জাক: এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। একটা হলো, বিগত সরকারের আমলে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এটা দুভাবে হয়েছে। একটা হলো দলীয়করণ। (উচ্চ আদালতে) বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর পড়াশোনা-জানাশোনা, অনেস্টি, ইন্টেগ্রিটি—এগুলো কোনো কিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তিনি দলের প্রতি কতটা অনুগত, সেটাই ছিল মূল বিষয়। একজন বিচারক যদি জানেন যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বিচারক বানানো হয়েছে, তাহলে শাসক দলের অনুগত না থেকে তাঁর কোনো উপায় থাকে না।
এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হতো। বিচার বিভাগের জন্য এগুলো ছিল একটি দুঃখজনক অধ্যায়। এ রকম অবস্থা থেকে আমাদের নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। এগুলো রাতারাতি ঠিক হবে না। তবে আমি আশাবাদী।
আপনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকেই আপনাকে জামায়াতের মধ্যে উদারপন্থী বা সংস্কারপন্থী হিসেবে বিবেচনা করতেন। কিন্তু দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের শুরুর দিকে আপনি দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আপনার পদত্যাগের সেই প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলবেন?
আবদুর রাজ্জাক: জামায়াতে পদত্যাগের কোনো রীতি নেই। দু-একজন পদত্যাগ করলেও সেটি চুপি চুপি করেন। আমি দীর্ঘ ৩৩ বছর জামায়াতে ছিলাম। এ কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি কেন পদত্যাগ করেছি, তা দলের লোকদের জানা উচিত। সেই সময় প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় আমার পদত্যাগের কারণ নিয়ে একাধিক খবর প্রকাশিত হয়েছিল। যা বলার আমি সেই সময়েই বলেছিলাম, এখন নতুন করে কিছু বলতে চাই না।
দল থেকে পদত্যাগ করে আপনি যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন, তাতে বলেছিলেন, জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি। আপনি মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আপনার সেই পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে জামায়াত কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করেন?
আবদুর রাজ্জাক: আপাতত আমরা তেমন কিছু দেখছি না। কিন্তু জামায়াতের নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। অপেক্ষাকৃত তরুণ লোকজন, নতুন মুখ নেতৃত্বে এসেছেন। জাতির সামনে তাঁরা বক্তব্য রাখছেন। তাঁদের অনেকেই বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ। আমি আশা করি, জামায়াতকে তাঁরা সঠিক পথে পরিচালিত করবেন।
আপনি ২০১৯ সালে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, জামায়াত দেশে ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জামায়াতে ইসলামী বিলুপ্ত করার পরামর্শও দিয়েছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন জামায়াত সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আবদুর রাজ্জাক: বর্তমানে জামায়াত এবং তার ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা প্রশংসনীয়। যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের সবার কাছে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার, পর্দার আড়ালে থেকে কীভাবে তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে সহযোগিতা করেছে। এর ফলে আমরা দেখেছি, (৫ আগস্ট) সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে প্রথম যে বৈঠক হয়, সেখানে জামায়াতের আমিরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এখনো জাতীয় ইস্যুগুলোতে জামায়াতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে।
আমি আশা করব, জামায়াত আরও ভালো ভূমিকা রাখবে, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় জামায়াতের মতো সুশৃঙ্খল দল আর নেই। সুতরাং প্রয়োজন হচ্ছে এই বিশাল কর্মী বাহিনীকে কাজে লাগানো। আমি আশা করব, জামায়াত নেতারা সেই কাজ করতে সক্ষম হবেন।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান ও ভারতেও জামায়াতে ইসলামী আছে। আপনার কাছে বাংলাদেশের জামায়াতকে সবচেয়ে সুশৃঙ্খল কেন মনে হলো?
আবদুর রাজ্জাক: এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে জামায়াতকে যেমন অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, পাকিস্তান ও ভারতে তেমনটা যেতে হয়নি। শুধু ভারত-পাকিস্তান কেন, মিসর ছাড়া আর কোথাও এ রকম অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়নি। বিগত সরকারের আমলে জামায়াতের শীর্ষ ১০ নেতার মধ্যে ৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এরপরও জামায়াত টিকে আছে।
আপনি মিসরের কথা বললেন, মিসরে তো জামায়াতে ইসলামী নেই। মিসরে আছে মুসলিম ব্রাদারহুড। জামায়াতের সঙ্গে কি মুসলিম ব্রাদারহুডের কোনো সম্পর্ক আছে?
আবদুর রাজ্জাক: মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শিক বন্ধন আছে এবং সেটা আজকে থেকে নয়; হাসান আল বান্না ১৯২৮ সাল থেকে শুরু করেন মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিন, মাওলানা মওদুদী ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর থেকে দুটি সংগঠনের মধ্যে যথেষ্ট বোঝাপড়া হয়েছে। তারা একে অন্যকে সহোদর হিসেবে মনে করে। এ রকম আরও কিছু আন্দোলন গড়ে উঠেছে—তুরস্কে আক পার্টি (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি), তিউনিসিয়ায় এন্নাহদা এবং মরক্কোতে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। এগুলোর সঙ্গেও জামায়াতের একটা সুসম্পর্ক আছে।
জামায়াত থেকে পদত্যাগের পর আপনি এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। আপনি দলটির প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে সেই দল থেকেও আপনি পদত্যাগ করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টা একটু স্পষ্ট করবেন?
আবদুর রাজ্জাক: আমি এবি পার্টির কোনো সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলাম না, প্রধান উপদেষ্টা ছিলাম। বিভিন্ন দলে এ রকম অনেক উপদেষ্টা থাকে। যা–ই হোক, নীতিগত কিছু পার্থক্যের কারণে আমি পদত্যাগ করেছি। নীতিগত সেই বিষয়গুলো নিয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।
সংবাদমাধ্যমে এ রকম খবর প্রকাশিত হয়েছিল, এবি পার্টি আপনার চিন্তাপ্রসূত বা আপনি এই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
আবদুর রাজ্জাক: আমিও এমনটা দেখেছি; এ কারণে আমার পদত্যাগের খবরটা পত্রপত্রিকায় বেশ বড় করে এসেছে। আমি চাচ্ছিলাম, একটা সেন্টার রাইট পলিটিক্যাল পার্টি উইথ ইসলামিক রেফারেন্স (ইসলামি যোগসূত্রসহ মধ্য ডানপন্থী দল)। এটা বাংলাদেশে কার্যকর হবে। জামায়াতে ইসলামী তো ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। কিন্তু নতুন এই রাজনৈতিক দল ইসলাম থেকে অনুপ্রেরণা নেবে, কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের কথা বলবে না—এ ধরনের একটি সেন্টার রাইট পলিটিক্যাল পার্টি বাংলাদেশে প্রয়োজন। এটা আমার ভিশন (লক্ষ্য) ছিল।
এখনো এ ধরনের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আপনি মনে করেন?
আবদুর রাজ্জাক: এ ধরনের দল খুবই প্রয়োজন, যেটা ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) হবে, সবাইকে নিয়ে চলবে।
এ ধরনের কোনো দল কি এখন বাংলাদেশে আছে?
আবদুর রাজ্জাক: আপাতত তেমন কোনো দল দেখছি না। তবে ভবিষ্যতে এ রকম কোনো দলের উত্থান হলেও হতে পারে।
আপনি কি জামায়াতে ফিরে যাচ্ছেন, নাকি নতুন কোনো উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, নাকি রাজনীতি থেকে বাইরে থাকার চিন্তা করছেন?
আবদুর রাজ্জাক: দেখেন, আমি একজন আইনজীবী। আল্লাহ তাআলা আমাকে দিয়ে অনেক বড় বড় মামলা করিয়েছেন। আমি আইন অঙ্গনেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ১১ বছর পর দেশে আসলাম, আদালতে গেলাম। মনে হলো, আমি আমার আসল জায়গায় ফিরেছি। আমি আইনের অঙ্গনেই থাকতে চাই। তবে যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে একসময় আইন আর রাজনীতি এক হয়ে যায়।
ভোট ও জোটের রাজনীতিতে জামায়াত দীর্ঘদিন বিএনপির মিত্র ছিল। ২০২২ সাল থেকে দল দুটির মধ্যে কিছুটা দূরত্ব দৃশ্যমান হয়। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন জামায়াত-বিএনপির মধ্যে বিরোধ প্রকাশ পাচ্ছে। দল দুটির এই বিরোধকে কীভাবে দেখছেন?
আবদুর রাজ্জাক: একটা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকবে, ভিন্ন মতামত থাকবেই। এটা না হলে তো গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে বিকশিত হতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনটি ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকা উচিত।
প্রথম হলো, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব; কখনোই কোনোভাবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে আপস করা যাবে না; বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামি দল বা বাম দল—সবাইকে এ বিষয়ে অবশ্যই কমিটমেন্ট (অঙ্গীকার) করতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে গণতন্ত্র। আর তৃতীয়ত হচ্ছে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। আমি মনে করি, বিএনপি-জামায়াত এই তিন জিনিসে বিশ্বাস করে। তারপরও রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবেই।
আরেকটি কারণ হলো, যেহেতু রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ নেই; সুতরাং বিএনপি-জামায়াতের একে অপরকে প্রতিপক্ষ মনে করাটা বিচিত্র কিছু নয়। আমি মনে করি যে এটা বাংলাদেশের জন্য একটা সুস্থ রাজনীতি, যদি ওই তিনটি বিষয়ে আমরা খেয়াল রাখি।
একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি যে রাজনীতিকদের দায়িত্বশীল হতে হয়। একটা সময় আমাদের এখানকার রাজনীতির মান অনেক উন্নত ছিল। কিন্তু সেখান থেকে আমাদের অনেক অবনমন হয়েছে। প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে নির্মূল করার রাজনীতি চালু করা হয়েছিল। আমাদের এখান থেকে বের হয়ে পূর্বের ঐতিহ্যে ফিরতে হবে। এটা কি সম্ভব?
আমি মনে করি, সম্ভব। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে হবে। ছাত্ররা যদি কোনো উদ্যোগ নেয়, সেটা নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য ভালো কিছু হবে। কিন্তু রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ছাড়া আমরা অগ্রসর হতে পারব না। ৫ আগস্টের (গণ-অভ্যুত্থানের) পরও আমরা যদি পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে যাই, সেটা হবে সবচেয়ে দুঃখজনক। পুরোনো রাজনীতির মধ্যে দেশ ও জাতির কোনো কল্যাণ নেই।
বিএনপি তো জুলাই-আগস্টের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করছে।
আবদুর রাজ্জাক: আমি এ ধরনের পূর্বশর্তে বিশ্বাসী নই। কোনো দলেরই তাড়াহুড়া করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়। তাই নির্বাচনের আগেই সংস্কার নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হওয়া উচিত।
জামায়াতে ইসলামীর হয়ে আপনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়গুলো দেখাশোনা করতেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আপনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কীভাবে দেখেন?
আবদুর রাজ্জাক: আইডিয়ালি (আদর্শিকভাবে) বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এমন হতে পারত, যে রকম সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক তেমনটা নয়। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় হলো, আমাদের যা কিছু পাওনা ভারতের কাছে, বাংলাদেশ তা আদায় করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারকে একতরফা সমর্থন দিয়ে ভারত আমাদের গণতন্ত্র ধ্বংসে ভূমিকা রেখেছে।
একটা দেশের সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক বেশি দিন টেকে না। সম্পর্ক হতে হয় জনগণের সঙ্গে জনগণের। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে গিয়ে কাউকে ভারতবিরোধী হতে বলা হয়নি। কিন্তু মানুষ নিজের বিবেচনাতেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ছোটখাটো দায় থাকতে পারে, কিন্তু বহুলাংশে ভারতই দায়ী। আমরা চাই না এখানে ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্র হোক আর সেটা কাজে লাগিয়ে কেউ ক্ষমতায় চলে যাক। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারতকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুসারে, বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থার উত্থান তাদের জন্য একটি আশঙ্কার কারণ। বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?
আবদুর রাজ্জাক: এটা একটা জুজুর ভয়, এটা সঠিক নয়। একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ একটি মডারেট মুসলিম দেশ। এখানে কোনো দিন উগ্রবাদ মাথাচাড়া দেবে না। হতে পারে, কিছু লোক ওই ধরনের আদর্শে বিশ্বাসী হবে; বাংলা ভাই এ রকম একজন ছিল, আরও দু-চারজন ছিল। কিন্তু একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ কোনো সময়ই উগ্রবাদকে স্থান দেবে না, এটা ভারতের বোঝা উচিত।
ভারতে বিজেপির বদলে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কি তাদের অবস্থান বা বোঝাপড়ার কোনো পরিবর্তন হবে?
আবদুর রাজ্জাক: অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও এটা হবে না। এর কারণ হলো, ‘ডিপ স্টেট’; যারা অদৃশ্যভাবে ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। নির্বাচিত সরকারে যারাই আসুক, তাতে তাদের কিছু যায়-আসে না।
ভারতের মতো বাংলাদেশেও কি ‘ডিপ স্টেট’ অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে?
আবদুর রাজ্জাক: ‘ডিপ স্টেট’ সব দেশেই আছে, সব দেশেই থাকবে। আমাদের শক্তিশালী নেতৃত্ব দরকার। সেই ধরনের নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আবদুর রাজ্জাক: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।