Image description

বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন। তারও আগে ছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক এই তরুণ নেতার জন্ম ১৯৯৮ সালে ঢাকার বাড্ডায়। সমকালের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক শাহেরীন আরাফাত

সমকালআমরা এক বিশেষ পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদযাপন করছি। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

 

নাহিদ ইসলাম: বিজয়ের ৫৪ বছরে দাঁড়িয়ে আমাদের অনুভূতি গর্ব ও গ্লানিতে মিলেমিশে আছে। গর্ব এই কারণে যে, ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ ভাষা, সংস্কৃতি ও মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন থেকে উপনিবেশবাদ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অসম সাহসে লড়েছিল। আবার গ্লানি এই কারণে যে, এত বছর পরও আমরা সেই বিজয়ের পূর্ণ অর্থ বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি। বৈষম্য, দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির ফলে স্বাধীনতা বহু সময় নাগরিকের অধিকার হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনগুলো ও কেন? 

 

নাহিদ ইসলাম: মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলব এ অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সেই প্রাচীনকাল থেকেই কোনো শক্তি এখানে বেশিদিন সুবিধা করতে পারেনি। ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিভাবেই বাংলা ছিল স্বাধীনতাকামী অঞ্চল। দিল্লি-পিন্ডি তথা উত্তর ভারতের অধীনতা বাংলা কখনোই মেনে নিত না। একাত্তরের প্রেক্ষাপট তৈরির ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালের পার্টিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যদিও মূলধারার বয়ানে এর কথা তেমন আসে না। এখানকার মানুষ পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পাবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক চরিত্র, আইয়ুব খান তথা সেনাবাহিনীর স্বৈরাচার পাকিস্তান রাষ্ট্রকে গুটিকয়েক মানুষ ও গোষ্ঠীর মাঝে সীমাবদ্ধ করে তোলে। এরপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের নির্বাচন পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী ও তাঁর দল অংশ না নিলে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয় মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করে। 

সমকালপশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধের প্রধান কারণগুলো কী?

নাহিদ ইসলাম: পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধের প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় অংশ জোগালেও উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে তা বঞ্চিত ছিল। ফলে দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য ক্রমেই তীব্র হয়। একই সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবমূল্যায়ন করা হয় এবং বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে খাটো করে দেখা হতো, যা গভীর অপমান ও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় রাজনীতি, প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবিদের একচেটিয়া আধিপত্য পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার সংকুচিত করে এবং এই বহুমাত্রিক বঞ্চনাই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সংগ্রামকে অনিবার্য করে তোলে।

সমকাল: ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র স্থায়ী হয় না; সাংস্কৃতিক ভিন্নতার জন্য পাকিস্তানের বিভক্তি চূড়ান্ত ছিল– মুক্তিযুদ্ধ কি এই ধারণাকে সত্য প্রমাণ করল?

নাহিদ ইসলাম: পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও গন্তব্য শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল। ১৯৪৭ সালে আবুল হাশিম ও সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতারা অবিভক্ত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলার পক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফলে সেই সম্ভাবনা নষ্ট হয় এবং পূর্ব বাংলা বাধ্য হয়ে পাকিস্তান ফেডারেশনে যোগ দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র তার রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান আন্দোলন কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল না। পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক ও আশরাফ নীতির কারণে বাঙালি মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দুরা ক্রমে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভেদই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলে।

সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভবিষ্যতে কীভাবে মূল্যায়িত হবেন বলে আপনি মনে করেন?

নাহিদ ইসলাম: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান সব সময়ই প্রধান চরিত্র হিসেবে মূল্যায়িত হবেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের একপেশে, অনৈতিহাসিক আওয়ামী বয়ান থেকে বের হয়ে শেখ মুজিবকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা হবে বলে মনে করি। সেখানে শেখ মুজিব কোনো দেবতা হিসেবে পূজনীয় নন, বরং রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে তাঁর যাবতীয় ভুল-ত্রুটিসহই মূল্যায়িত হবেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী উভয় প্রেক্ষাপটেই মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি স্বাধীনতার প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন, তেমনি বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসকও ছিলেন।

সমকালচব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ভাঙা, জাতীয় নেতাদের নিয়ে কটূক্তি অহরহ দেখা যাচ্ছে। এ প্রবণতা কি সমাজে উগ্রবাদ বা সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার লক্ষণ? 

নাহিদ ইসলাম: মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে যে প্রবণতার কথা বলছেন, তার পেছনে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ অনেকাংশে দায়ী। মুক্তিযুদ্ধের একপেশে বয়ান তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগ সমার্থক বানিয়ে ফেলেছে দলটি। ফলে জনগণ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অনেক সময় মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপাদানে আক্রমণ করেছে। উগ্রবাদ বা সাম্প্রদায়িকতা এ ক্ষেত্রে সরাসরি সম্পর্কিত না। তবে মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মের বিপরীতে যারাই দাঁড় করাতে চায়, তারা এসব প্রবণতা তৈরির জন্য দায়ী। 

সমকালসরকার কী করছে?

নাহিদ ইসলাম: অন্তর্বর্তী সরকার আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সরকার এক প্রকার ব্যর্থ। এর ফলে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোও বিভিন্ন স্যাবোটাজ করার সুযোগ পেয়েছে।

সমকালপাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়েছে আদর্শগত কারণে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিসর্জন দেওয়ার মাধ্যমে সেই আদর্শকে অস্বীকার করা হচ্ছে না?

নাহিদ ইসলাম: মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কেউ বিসর্জন দিচ্ছে না। এটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের উত্তরসূরি। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ফ্যাসিবাদ ও বিভাজনের রাজনীতির বিরোধী আমরা। মুক্তিযুদ্ধ আর মুজিববাদ এক জিনিস না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতি বাংলাদেশে থাকা উচিত ছিল না। কিন্তু সেই অতীতমুখী রাজনীতিই বাংলাদেশের প্রধান তর্ক হয়ে ওঠে। আমরা ইতিহাসকে ধারণ করে ভবিষ্যৎ নির্মাণের রাজনীতি করতে চাই। 

সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত অধ্যায় ও ইতিহাসের অবিকৃত পাঠে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের জন্য এনসিপির কোনো পরিকল্পনা আছে?

নাহিদ ইসলাম: আছে, তবে এটি সময়সাপেক্ষ কাজ। ইতোমধ্যে আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসে আমরা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে আলোচনার আয়োজন করেছি। বিভিন্ন সুপরিচিত ব্যক্তি এসে তাদের বক্তব্য দিয়ে গেছেন; কাজ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি আমরা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। মূলত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত বেশি আলোচনা, পঠন-পাঠন বাড়ানো যাবে, ততই এর গণচরিত্রটি বের হয়ে আসবে।

সমকাললাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ ও বীরত্বে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাপ্ত সম্মান কীভাবে পেতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?

নাহিদ ইসলাম: তারা যে জন্য বৈষম্যহীন বাংলাদেশের লড়াই করেছেন তার প্রতিফলন সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রে দেখা গেলেই তারা সম্মানিত হবেন বলে আমি মনে করি। রাষ্ট্র যখন থেকে জনগণকে বিভাজিত করে, বঞ্চিত করে গুটিকয়েকের স্বার্থে কাজ করা বন্ধ করবে তখনই তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান পাবেন।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।

নাহিদ ইসলাম: সমকালকেও ধন্যবাদ।