
জুলাই জাতীয় সনদ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনে জোট গঠন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হলেও এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়ে গেছে। আপনি কি মনে করেন, এটি রাজনীতিতে নতুন করে কোনো সংকট তৈরি করবে?
হাসনাত কাইয়ূম: সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে যতটুকু ভিন্নমত আছে তা যেহেতু মীমাংসাযোগ্য, রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থে এই বিরোধের একটা গ্রহণযোগ্য মীমাংসায় উপনীত হবে বলে আশা করছি। তবে বিরোধ যদি নিষ্পন্ন না হয়, তাহলে নতুন সংকটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল এনসিপি এখনো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। এটিকে কীভাবে দেখেন?
হাসনাত কাইয়ূম: আমাদের কাছে এটাকে দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়েছে। তারা যেসব বিষয়কে পূর্বশর্ত হিসেবে হাজির করেছে, তার কোনো কোনোটা আমাদেরও দাবি। এই দাবিগুলোর ফয়সালা করে, অনুষ্ঠানটি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করা গেলে এর যে গুরুত্ব থাকত, তারা উপস্থিত না হওয়ায় সেটা অনেকাংশে খর্ব হয়েছে।
জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে জামায়াতের আন্দোলন একটি রাজনৈতিক প্রতারণা—এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছে জামায়াত। আপনি কি মনে করেন, পক্ষে-বিপক্ষে এমন বক্তব্য রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা দুটি দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করবে?
হাসনাত কাইয়ূম: ইতিমধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলেই এসব পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসছে। জামায়াত এবং এনসিপি উভয়েই নিজেদের বক্তব্য থেকে সরে আসায় কিংবা পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বদলানোয় পারদর্শী। তাই ভবিষ্যতে উভয় দলের মধ্যে নতুন করে সখ্য গড়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমাদের কাছে এটাকে দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়েছে। তারা যেসব বিষয়কে পূর্বশর্ত হিসেবে হাজির করেছে, তার কোনো কোনোটা আমাদেরও দাবি। এই দাবিগুলোর ফয়সালা করে, অনুষ্ঠানটি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করা গেলে এর যে গুরুত্ব থাকত, তারা উপস্থিত না হওয়ায় সেটা অনেকাংশে খর্ব হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার চেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার পরামর্শ দেওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে অনেকে মনে করেন, সনদ প্রস্তুত, ভিন্নমত, স্বাক্ষরসহ অনেক বিষয়ে বিএনপির চাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আপনি কী মনে করেন?
হাসনাত কাইয়ূম: ঐকমত্য কমিশন এবং সরকার প্রধানত তিনটি দলকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে এটা নিরপেক্ষ আচরণের সীমাকে অতিক্রম করেছে। কিন্তু মতামত প্রদান ও মতামত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই অভিযোগ সত্য নয়।
গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি দাবি জানিয়েছে, এই মুহূর্ত থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় যেতে হবে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
হাসনাত কাইয়ূম: আমার মনে হয় বিষয়গুলোকে যত কম জটিল রাখা যায়, তত ভালো। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে যা যা করা প্রয়োজন, সরকার যেন এখন সেদিকে অধিক মনোযোগ দেয়, এটা সবারই চাওয়া। সব তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ভালো নির্বাচন করেছে এমন তো নয়। তাই এই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার চেয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার পরামর্শ দেওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এই নির্বাচন নিয়ে আপনার দৃষ্টিতে কোনো শঙ্কা আছে কি না?
হাসনাত কাইয়ূম: শঙ্কা তো অনেক রকম। তবু আশা করতে চাই, একটা গ্রহণনযোগ্য নির্বাচন ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। তবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে করা যাবে, সেটা নিয়ে সরকার যদি সব অংশীজনের সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করতে পারে, সেটা নির্বাচনকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিতে পারে।
সব তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ভালো নির্বাচন করেছে এমন তো নয়। তাই এই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার চেয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার পরামর্শ দেওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলো তাদের ভোট এক বাক্সে আনার কথা বলছে। বিএনপিও তাদের মতো করে ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক মেরুকরণটা ঠিক কেমন হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
হাসনাত কাইয়ূম: ইসলামপন্থীদের ভোট এক বাক্সে আনার স্লোগানটি শুনতে যত আকর্ষণীয় এবং সহজ মনে হয়, বাস্তবতা তেমন নয়। অন্য সব ইসলামি দল এবং জামায়াতের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য যুদ্ধাপরাধবিষয়ক। ইসলামি দল মানেই তো যুদ্ধাপরাধী দল নয়, তাই এ পার্থক্য ঐক্যের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করি। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে ছোট–বড় বেশ কয়েকটি নির্বাচনী জোট গড়ার তৎপরতা আছে। এসব তৎপরতার কোনো কোনোটি আরও বড় কোন জোটে বিলীন হয়ে যেতে পারে বা আরো ছোট ছোট কিছু জোট গড়ে উঠতে পারে। সব রকম তৎপরতাই চোখে পড়ছে।
গণতন্ত্র মঞ্চসহ অপরাপর দল নিয়ে জোট গঠনের আলোচনা এখনো সম্ভাবনার পর্যায়েই আছে, বিশেষ কোনো অগ্রগতি সেই। তবে নানা দলের নানামুখী চেষ্টা অব্যাহত আছে।
গণতন্ত্র মঞ্চসহ ৯টি দল জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন থেকে দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক বৃহত্তর সমঝোতার বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক এই সমঝোতার আলোচনা কতটুকু এগোল?
হাসনাত কাইয়ূম: গণতন্ত্র মঞ্চসহ অপরাপর দল নিয়ে জোট গঠনের আলোচনা এখনো সম্ভাবনার পর্যায়েই আছে, বিশেষ কোনো অগ্রগতি সেই। তবে নানা দলের নানামুখী চেষ্টা অব্যাহত আছে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
হাসনাত কাইয়ুম: আপনাকেও ধন্যবাদ।