ঢাকা–দিল্লির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে রাশিয়া। কারণ এটি শুধু দুই দেশের জন্য নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক বিষয়, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যদি ফলপ্রসূ সমাধান না আসে। ফলে ভারতের সঙ্গে যতদ্রুত সম্ভব উত্তেজনা কমাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকার রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার খোজিন।
সোমবার সকালে রাজধানীর রাশিয়া দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ঢাকায় নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার খোজিন। দূতাবাসের অন্যান্য কূটনীতিকরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ–ভারত উত্তেজনাপূর্বক সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে আলেকজান্ডার খোজিন বলেন, আমরা অন্য দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সংঘাত নিয়ে কথা বলি না। তবে আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। তবে পরিস্থিতিটি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, কারণ এটি শুধু দুই দেশের জন্য নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক বিষয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যদি ফলপ্রসূ সমাধান না আসে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য পড়েছি। তিনি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানের পথে এগোনোর কথা বলেছেন, যাতে উত্তেজনা যতটা সম্ভব কমানো যায়। আমরা আমাদের প্রতিবেশী বেছে নিতে পারি না। ইউক্রেনের সঙ্গে আমাদের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটিও আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। একইভাবে এখানকার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আমরা উদ্বিগ্নের কথা জানিয়েছি। ভারতের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব উত্তেজনা কমানো প্রয়োজন—এটাই ভালো। কারণ ইতিহাস থেকে আমরা জানি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের বড় ভূমিকা ছিল এবং রাশিয়াও তখন সমর্থন দিয়েছিল। ভারত, বাংলাদেশ ও রাশিয়া কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছিল। সে সময় মাইন পরিষ্কারের কাজেও সহযোগিতা করা হয়েছিল। আমার অবস্থান পরিষ্কার—যেকোনো ধরনের উত্তেজনা যত দ্রুত সম্ভব কমাতে হবে।
রাশিয়া ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখছে– বিষয়টি কি সত্যি? উত্তরে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, আমাদের (মস্কো–দিল্লির) দ্বিপক্ষীয় এজেন্ডাতে বাংলাদেশ নীতি নিয়ে কথা বলবো না। একটি বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী (মস্কো–দিল্লির) পর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, সেটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। সেখানে শ্রীলংকা, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ নিয়ে কথা হয়েছে। বিষয়টি আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, আমরা দুই দেশের (ঢাকা–দিল্লির) উত্তেজনা কমানোর পক্ষে।
মস্কো ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে কোনো মধ্যস্থতা করবে কি না– উত্তরে আলেকজান্ডার খোজিন বলেন, আমরা অন্য দেশের দ্বিপক্ষীয় সংঘাতের মধ্য জড়াই না। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘাত নিয়ে আমাদের অবস্থানের বিষয়ে বলতে গেলে, পাকিস্তান রাশিয়াসহ অন্য দেশকে কাশ্মীর সংঘাতে মধ্যস্থতার জন্য বলেছে, আমরা বলেছি শিমলা চুক্তি ও লাহোর ঘোষণা অনুযায়ী এ সংঘাত দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের। ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা নিরসনে ভবিষ্যত সরকারকে উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
অর্থনীতি ও গণতন্ত্রে রাশিয়া কিভাবে সহযোগিতা করতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাদের সময়ের পরিক্ষিত বন্ধু। আমাদের আগ্রহ হচ্ছে দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে ফলাফল ভিত্তিক সহযোগিতা তৈরি করা। ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন, আমরা দেশের জনগণের সঙ্গে কাজ করি। রূপপুর বিদ্যুতকেন্দ্র বিগত সরকারের সময়ে সই হয়েছিল। এখন আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের চুক্তিতে এবং ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে সই করবো। এ চুক্তিটি আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি, আমাদের ব্যবসার জন্যও। কারণ রাশিয়ার ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়ীরা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন থেকে রাশিয়ার প্রত্যাশা নিয়ে জানতে চাইলে আলেকজান্ডার খোজিন বলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। রাশিয়া এ নির্বাচন নিয়ে এখনই কোনো মূল্যায়ন দিতে পারবে না, কারণ নির্বাচন এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। আমরা একটি ইতিবাচক, বন্ধুত্বপূর্ণ, অহিংস, চরমপন্থামুক্ত এবং সহিংসতামুক্ত পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত। কিন্তু আমরা সংসদ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা আশা করে বসে আছি, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত দিন ১২ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ প্রেরণ নিয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণের অপেক্ষায় রয়েছি। আমরা ইতিবাচকভাবে সাড়া দিতে প্রস্তুত এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ এলে তা মস্কোতে জানানো হবে। অতীতে রাশিয়া বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে।
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্পের অর্থায়ন জটিলতা নিয়ে জানতে চাইলে আলেকজান্ডার খোজিন বলেন, অর্থ পরিশোধ বিলম্বিত হওয়া শুরু করছে দেড় বছরের মতো। সংশোধিত চুক্তি অনুযায়ী প্রথম কিস্তি পরিশোধ করা হবে ২০২৮ সালের সেপ্টেম্বরে, যা রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেছে।
বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চলাচল নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরাসরি ফ্লাইট চালানো নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছি। সরাসরি ফ্লাইট চালাতে হলে দুদেশের মধ্যে চুক্তি থাকার বিষয় রয়েছে। এ নিয়ে দু্ই দেশের সরকারের আলোচনায় বসতে হবে।
রোহিঙ্গার কারণে অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে দূতাবাসের প্রথম সচিব (রাজনৈতিক) অ্যানেস্তেশিয়া নিমোভা বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রাশিয়ার দীর্ঘ দিনের বন্ধু। রাখাইনের পরিস্থিতি এবং শরণার্থী অঞ্চলে ঝুঁকি তৈরি করছে। আমরা যেকোনো আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিপক্ষে। শুধুমাত্র সরাসরি সম্মানের সঙ্গে আলোচনার পথ সংকট সমাধান করতে পারে। আর আমরা এতে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।