Image description

ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক সফরকে ঘিরে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কয়েক শ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এবং এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি—দুই দেশের কৌশলগত ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু সেই সফরে সৌদি–ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের মতো সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুতে যুবরাজের অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও অনড়। তিনি জানিয়ে দেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা ছাড়া রিয়াদ কোনোভাবেই আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের পথে হাঁটবে না।

ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সামনে যুবরাজের মন্তব্য ছিল ইঙ্গিতপূর্ণ। তাঁর ভাষায়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সৌদি আরব আগ্রহী, কিন্তু দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের নিশ্চয়তা ছাড়া আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই অবস্থান কূটনৈতিক আলোচনার পুরোনো ভারসাম্যকেই আবার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। গত কয়েক দশকে একের পর এক পরিবর্তন হলেও ইসরায়েলের ফিলিস্তিন দখলনীতি এবং আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতিই আরব বিশ্বকে দ্বিধায় রেখেছে।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকেই আরব ও মুসলিম দেশগুলো তাকে বয়কট করে আসছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘স্বাভাবিক সম্পর্ক’ বলতে যে বাণিজ্য, গোয়েন্দা সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ বোঝানো হচ্ছে, তা বহু মুসলিম দেশের কাছে এখনও অস্বস্তিকর। কারণ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে দখলদারিত্ব, গাজা–পশ্চিম তীরের সামরিক দমননীতি এবং লেবানন–সিরিয়া–ইয়েমেনে অভিযানে ইসরায়েল বহুদিন ধরেই বৈরী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। ফলে এমন একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করার ধারণা আরব জনমতকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে।

 

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে প্রথম বড় পদক্ষেপ আসে সত্তরের দশকের শেষ দিকে। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মধ্য দিয়ে মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলে আরব বিশ্বের বড় অংশই তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। জর্ডান পরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একই পথে হেঁটে যায়। এরপর ২০০২ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরব লিগ ‘আরব শান্তি উদ্যোগ’ দেয়—যেখানে দখলকৃত সব ফিলিস্তিনি ভূমি ও গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহারকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার শর্ত করা হয়। কিন্তু ইসরায়েল বারবার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

 

 আমলে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান একে একে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে সই করে ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এই চুক্তির পর আমিরাত–ইসরায়েল বাণিজ্য দ্রুত বাড়ে, প্রতিরক্ষা খাতেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তবে এসব চুক্তি ফিলিস্তিনিদের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে ধরা পড়ে; যদিও আরব বিশ্ব থেকে তেমন বড় প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা শুরুর পর পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। ৬৯ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর পর আরব রাষ্ট্রগুলোর ভেতরের জনমত প্রবলভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। জর্ডান ও মরক্কো ইতিমধ্যে বিক্ষোভের মুখে পড়েছে, তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিয়েছে। কাতার স্পষ্ট জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো চুক্তি অসম্ভব। সিরিয়ায় নতুন প্রশাসনও একই অবস্থান নিয়েছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশও গাজা ইস্যুতে দৃঢ়ভাবে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থানে রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবের অবস্থান নতুন চুক্তিকে পুরোপুরি থামিয়ে দিয়েছে। নেতানিয়াহুর সরকার পশ্চিম তীর দখলকে আনুষ্ঠানিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে, লেবানন–সিরিয়ায় সামরিক অভিযান বাড়াচ্ছে এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি মানছে না—এসব পরিস্থিতিতে রিয়াদের পক্ষে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের উদ্যোগ রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ট্রাম্পের নতুন শান্তি পরিকল্পনা অনুমোদন করলেও তার বাস্তবায়ন এখনো অনিশ্চিত। গাজায় আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানোর কথা থাকলেও ইসরায়েলের নিয়মিত হামলার কারণে সেই উদ্যোগও ঝুলে আছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক মানচিত্র অনেকটাই নির্ভর করছে গাজার যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি কীভাবে বদলায় তার ওপর।

গণহত্যা থামাতে না পারলে বা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পথে বাস্তব কোনো উদ্যোগ না এলে আরব বিশ্বের কোনো দেশই আপাতত ইসরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দিতে আগ্রহী নয়—এটাই এখন স্পষ্ট বাস্তবতা।