থানায় নথিভুক্ত হওয়া মামলার এজাহার ও সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তথ্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিচ্ছে না পুলিশ। ফলে জেলার আইন-শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান হয়েও চলমান অপরাধের তথ্য জানতে জেলা প্রশাসককে অপেক্ষা করতে হয় সাত থেকে ১৫ দিন।
থানায় নথিভুক্ত হওয়া মামলার এজাহার ও সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তথ্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিচ্ছে না পুলিশ। ফলে জেলার আইন-শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান হয়েও চলমান অপরাধের তথ্য জানতে জেলা প্রশাসককে অপেক্ষা করতে হয় সাত থেকে ১৫ দিন। এতে সাদা পোশাকে তুলে নেয়াসহ ক্রমবর্ধমান অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না জেলা প্রশাসন এবং জেলা পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত জেলা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কমিটি। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কয়েক দফা তাগাদা দেয়া হলেও সাড়া মেলেনি পুলিশের কাছ থেকে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশের তথ্য সরবরাহ নিয়ে রীতিমতো বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ জটিলতা আসন্ন নির্বাচনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপারকে (এএসপি) তার পুলিশ সুপারের মাধ্যমে এফআইআর ও জিডি থেকে তথ্যের ভিত্তিতে বিপি ফরম-১৬ পূরণ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিদিন দিতে হবে। তবে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে নিয়মিত তথ্য না দেয়ায় জেলা পর্যায়ে নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফলপ্রসূভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি কোথাও সাদা পোশাকে কাউকে তুলে নেয়া হলেও সেই তথ্য নজরে আসে না জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির। ফলে ভুক্তভোগীদেরও কোনো সেবা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এ কমিটির কাছ থেকে। বর্তমানে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা ও পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে যথাক্রমে সাপ্তাহিক গোপনীয় প্রতিবেদন ও পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠানো হয়। কিন্তু প্রতিদিন সংঘটিত আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এক সপ্তাহ বা ১৫ দিন পরে পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও ফলপ্রসূভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। পাশাপাশি ঘটনার প্রকৃত তথ্য যথাসময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরেও আনা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব সমন্বয় কমিটির। এ কমিটির প্রধান জেলা প্রশাসক। জেলার সব ধরনের অপরাধের তথ্য তার কাছে হালনাগাদ থাকতে হবে। তা না হলে নাগরিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে। বিশেষ করে ধরপাকড়, অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের মতো ঘটনাগুলোর সুযোগ তৈরি হয়। নাগরিকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। আর নিয়মিত জেলা প্রশাসককে তথ্য সরবরাহের বাধ্যবাধকতা থাকলে এ ধরনের কার্যক্রমের সুযোগ কমে আসে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। ফলে জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয়ের বিকল্প নেই।
সমন্বিতভাবে কাজ করার মধ্য দিয়েই কেবল জেলার কাঙ্ক্ষিত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসন ও পুলিশ উভয়েরই কাজের ধরন ভিন্ন। তবে এখানে অবশ্যই সমন্বয়ের বিষয় আছে। প্রতি বছর ডিসি ও এসপিদের নিয়ে যে সম্মেলন হয় সেখানে কিন্তু বারবার পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে নেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সবাই মনে করে সমন্বয় করা মানে তার গুরুত্ব কমে যাওয়া। সমন্বয় করতে গেলে কে আগে বা কে বেশি ক্ষমতাবান সেই দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায়। একটি জেলার মধ্যে কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরিতে আইন প্রয়োগে সমন্বয় করতে হবে। পরস্পরের সহযোগী হয়ে কাজ করবে পুলিশ এবং জেলা প্রশাসন। কে ছোট কে বড় এটা বিবেচ্য নয়। কিন্তু আমরা দেখি অধিকাংশ জেলায় ডিসি অফিসের সঙ্গে এসপি অফিসের নীরব একটা যুদ্ধ চলে। নাগরিকের অধিকার এবং নিরাপত্তা স্বার্থে সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। তা না হলে আসন্ন নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অক্টোবরের সমন্বয় সভায়ও এ বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, সব উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত প্রতিবেদনের তথ্য পাওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আইনি বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন অন্য কোনো ফর্মাল সোর্স নেই। থানার প্রতিদিনের তথ্য না পাওয়া গেলে এলাকার চলমান সমস্যা সম্পর্কে জেলা প্রশাসকের সম্যক অবগত থাকার কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে অবগত হতে সাত থেকে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হয় জেলা প্রশাসককে। তিনি যতক্ষণে জানতে পারেন ততক্ষণে দেখা যায় অপরাধীরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। দিনের অপরাধের তথ্য দিনেই জেলা প্রশাসককে সরবরাহ করতে ২০২১ সাল থেকে পাঁচ দফায় পুলিশ সদর দপ্তরকে চিঠি দেয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জেলা প্রশাসক বলেন, ‘অতীতে প্রায়ই দেখা গেছে পুলিশের সঙ্গে আমাদের বিস্তর দূরত্ব ছিল। বিশেষ করে জেলার আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠকগুলোতে পুলিশ আমাদের কাউকে রাখতে অনীহা জানাত। আবার কখনো কখনো এসপিদের পরিবর্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বৈঠকে এসেছেন। অথচ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ আছে এসপি ও ডিসিদেরই উপস্থিত থাকতে হবে। গত সরকারের আমলে এমনও দেখা গেছে, এসপিরা পুলিশ সদর দপ্তর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডিসিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আবার ডিসিরাও এসপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন। এসব বিরোধ থেকে আমরা বের হতে চাই। কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ জেলা প্রশাসক বা তাদের প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।’
তবে আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধের তথ্য পেতে কিছুটা সময় লাগলেও মৌখিকভাবে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসন এবং জেলা পুলিশের সমন্বয়ে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। প্রতিদিন বিপি ফরম-১৬ পূরণ করে জেলার সব অপরাধের তথ্য সরবরাহের কথা থাকলেও সেটা অনেক সময় নিয়মিত হয় না। তবে উল্লেখযোগ্য অপরাধের তথ্য নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করা হয়। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হয়।’
অবশ্য পুলিশ মনে করে, জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে জেলা প্রশাসনের খুব বেশি ভূমিকা নেই। সেজন্য তাদের সাত বা ১৫ দিন পরপর অপরাধের তথ্য পেলেই যথেষ্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা ব্রিটিশ শাসন আমলের একটি বিধান। তখন জেলার সবকিছু জেলা প্রশাসককে কেন্দ্র করে চলত। কিন্তু এখন সময় বদলেছে, কাজের ধরনও বদলেছে। এ তথ্যের সঙ্গে জেলার আইন-শৃঙ্খলার খুব বেশি সম্পর্ক নেই। সাধারণত প্রতিদিন মামলার তথ্য জেলা প্রশাসককে পাঠানো হয় না। প্রতি মাসে জেলায় আইন-শৃঙ্খলার মিটিং হয়। মিটিংয়ের এক-দুইদিন আগে জেলার মামলার সংখ্যা এবং কোন থানায় কী ধরনের কত মামলা হয়েছে তার সারাংশ পাঠানো হয়। জেলা প্রশাসক থানা পরিদর্শনে এলে এসবের খোঁজখবর নেন। মোবাইল কোর্ট চালালে পুলিশ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পুলিশের তেমন কোনো কাজ নেই।’
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে আইনের মধ্যে থেকে সব ধরনের তথ্য সরবরাহ করা হয় বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জেলা আইন-শৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটির চাহিদা অনুযায়ী সব তথ্য পুলিশের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়। সেই তথ্য পর্যালোচনা করেই পরবর্তী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন অভিযান কার্যক্রমেও পুলিশ সার্বিক সহযোগিতা করে।’