মার্কিন সরকারের নীতিতে নিজের প্রভাব রাখতে প্রেসিডেন্টদের মূল হাতিয়ার এক্সিকিউটিভ অর্ডার বা নির্বাহী আদেশ। ক্ষমতা নেওয়ার পর সেই হাতিয়ার ব্যবহারে এক মুহূর্তও দেরি করেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প।
শুরুতেই বাইডেন আমলের ৭৮টি নির্বাহী আদেশ বাতিল করেন মি. ট্রাম্প। সব মিলিয়ে এক শ’র বেশি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন ইতিমধ্যে।
দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাহী আদেশের ঝড় তুলবেন বলে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তার আক্ষরিক বাস্তবায়ন করে দেখালেন দেশটির ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এক্সিকিউটিভ অর্ডার কী?
এক কথায় এক্সিকিউটিভ অর্ডার হলো যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া একটি লিখিত আদেশ, যার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না।
অর্থাৎ, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত জারি করতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ বলে প্রেসিডেন্ট এই আদেশ জারি করার ক্ষমতা পান। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা একজন প্রেসিডেন্টের ওপর অর্পিত হবে।’
নির্বাহী আদেশের বদৌলতে সাধারণ ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন নীতি নাটকীয়ভাবে পুরোপুরি উল্টে যাওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটতে পারে।
এই যেমন সোমবার প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার আদেশে সই করেছেন ট্রাম্প।
এর আগে ২০১৭ সালে বিতর্কিত দুটি তেল পাইপলাইনের নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিলেন তিনি। যা পূর্বসূরী ওবামা প্রেসিডেন্সির নীতিগত অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ওবামা আমলে ২০১৫ সালে ক্রিসমাস ইভে (বড়দিনের আগের সন্ধ্যা) সরকারি দপ্তরগুলো আধাবেলা ছুটি দেওয়ার মতো সাধারণ সিদ্ধান্তও নির্বাহী আদেশে পাল্টে দেওয়ার নজির আছে মি. ট্রাম্পের।
প্রেসিডেন্টরা কেন এটি জারি করেন?
কখনো কখনো যুদ্ধকালীন সময় কিংবা অভ্যন্তরীণ সংকট সামাল দিতে নির্বাহী আদেশ জারি করা হয়।
নিজের ১২ বছরের মেয়াদকালে তিনি ৩ হাজার ৭২১টি নির্বাহী আদেশে সই করেছিলেন।
১৯৫২ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান একটি ধর্মঘট এড়াতে ইস্পাত শিল্পকে সরকারের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে।
২০২০ সালে বাইডেন যেমন অফিসের প্রথম দিনেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে পুনরায় যোগদানের প্রক্রিয়া শুরু করার একটি আদেশে স্বাক্ষর করেন। তার পূর্বসূরি ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তখন বলেছিলেন, ‘এটি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিপর্যয় এড়াতে সহায়তা করবে’।
অবশ্য ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিনেই চুক্তি পরিত্যাগের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, প্রথম মেয়াদে ২২০টি নির্বাহী আদেশ সই করেছিলেন ট্রাম্প।
জো বাইডেন তার সদ্য সমাপ্ত মেয়াদকালে ১৬০টি, বারাক ওবামা তার পরপর দুই দফা মেয়াদে ২৭৭টি এবং তার পূর্ববর্তী জর্জ ডব্লিউ বুশ ২৯১ নির্বাহী আদেশে সই করেছিলেন।
প্রতিহত করার ক্ষমতা আছে কার?
নির্বাহী আদেশের এখতিয়ার আইনের সীমারেখার ঊর্ধ্বে নয়। অন্তত কাগজে কলমে, প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত আইনগত পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও সবসময় এর প্রতিফলন দেখা যায় না।
কোনো আদেশ যদি গ্রহণযোগ্যতার সীমা অতিক্রম করে, তাহলে এটি আইনি যাচাই-বাছাইয়ের মুখে পড়তে পারে।
এ ছাড়া, কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা রয়েছে আইন পাসের মাধ্যমে কোনো নির্বাহী আদেশকে রুখে দেওয়ার। কিন্তু কনস্টিটিউশন সেন্টারের ব্যাখ্যা বলছে, রাষ্ট্রপতির আবার সেই আইনের ওপর ভেটো দেওয়ার এখতিয়ার আছে।
রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর কেন?
কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই প্রেসিডেন্টের নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে বলে নির্বাহী আদেশগুলো নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়।
২০১০ সালে রিপাবলিকানরা ওবামার স্বাস্থ্যসেবা পরিবর্তনের একটি অংশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন এই যুক্তিতে যে তিনি সাংবিধানিক ক্ষমতার চেয়ে বেশি প্রয়োগ করেছেন।
ট্রাম্পের আগের মেয়াদে কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়েছিল। বাইডেন হোয়াইট হাউজে এসে এটি বাতিল করেন।
কংগ্রেসের সদস্যদের কর্মকাণ্ড যদি প্রেসিডেন্টের কাছে অত্যন্ত ধীরগতির মনে হয় কিংবা কোনো নতুন আইনের বক্তব্য স্পষ্ট করা প্রয়োজন হয় তাহলেও তিনি নির্বাহী আদেশ জারি করতে পারেন।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিনের আদেশ
প্রথম দিনে নির্বাহী আদেশের ‘ঝড়’ তোলার তালিকায় আছে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আদেশটি। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের যে বিধান দেশটির সংবিধানে আছে সেটি বাতিলের পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ফেডারেল এজেন্সিগুলোকে অবৈধ অভিবাসী কিংবা সাময়িক ভিসাধারী বাবা-মায়ের সন্তানকে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য ৩০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। যদিও এ পদক্ষেপ আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
আলোচিত আদেশের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরুর আদেশও আছে।
এ ছাড়া, মি. ট্রাম্প টিকটককে আইনি বাধ্যবাধকতা পালনের জন্য ৭৫ দিনের সময় দিয়ে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গায় যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক হওয়া প্রায় দেড় হাজার মানুষকে ক্ষমা করেছেন তিনি।
আদেশের মাঝে আরেকটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা।
এর আগে ক্ষমতা ছাড়ার শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফৌজদারি মামলার হুমকিতে রয়েছেন এমন বেশ কয়েকজনকে ক্ষমা করে দেন।
নিজের প্রথম ভাষণে ট্রাম্প বলেছেন, ওই আদেশও বাতিল হবে।
তবে এটাও মনে থাকা ভালো, প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের সই করা ২২০টি নির্বাহী আদেশের বেশ কয়েকটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। সূত্র: বিবিসি বাংলা