Image description

পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দেশটির সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী পাস করেছে। এই বিতর্কিত সংশোধনী দেশটির সেনাপ্রধানের ক্ষমতা আরও বাড়াবে এবং তাঁকে আজীবন আইনি দায়মুক্তি দেবে। একই সঙ্গে এটি সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতাও সীমিত করবে। সমালোচকেরা একে ‘গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক’ বলে বর্ণনা করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার রাতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তথা জাতীয় পরিষদে বিলটি পাস হয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির—যিনি দেশটির ডি–ফ্যাক্টো শাসক হিসেবে পরিচিত—এই ২৭ তম সংশোধনীর প্রধান উপকারভোগী।

বিলটি এখন সামান্য পরিবর্তনের জন্য সিনেটে ফেরত পাঠানো হবে। এর আগে উচ্চকক্ষ সিনেট গত সোমবার এটি অনুমোদন করে। এরপর প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি এতে স্বাক্ষর করলে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে।

এই সংশোধনীর অধীনে এ বছর শুরুর দিকে পাঁচ তারকাবিশিষ্ট জেনারেল হিসেবে মনোনীত হওয়া সেনাপ্রধান আসিম মুনির অভূতপূর্ব ক্ষমতা অর্জন করবেন। তাঁকে চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস—নামে নতুন একটি পদে উন্নীত করা হবে। এর ফলে তিনি কেবল সেনাবাহিনীই নয়, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীরও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পাশাপাশি তাঁকে আজীবন ফৌজদারি বিচারের হাত থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং ‘The Army and Democracy: Military Politics in Pakistan’—বইয়ের লেখক আকিল শাহ বলেছেন, মুনির ‘সাংবিধানিকভাবে অভূতপূর্ব এক সুরক্ষিত পদ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজে ও ভবিষ্যতের সেনাপ্রধানদের ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।’ তিনি বলেন, সংশোধনীতে দেওয়া দায়মুক্তি ‘নাগরিক কর্তৃত্বের নীতিকে উপহাসে পরিণত করেছে, কারণ এটি তাকে সব ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছে।’

এই সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যপরিধিও ব্যাপকভাবে খর্ব করেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে এই প্রতিষ্ঠানটিই এত দিন নির্বাহী ক্ষমতার একমাত্র নিয়ামক হিসেবে টিকে ছিল। সংশোধনী অনুযায়ী—সুপ্রিম কোর্টের ঊর্ধ্বে একটি নতুন ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত গঠন করা হবে, যার বিচারপতিদের মনোনয়ন দেবে নির্বাহী বিভাগ। সমালোচকেরা বলছেন, এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবশিষ্ট প্রতীকটিও ভেঙে পড়বে। বিচারপতিদের বদলি বা স্থানান্তর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তও এখন থেকে এককভাবে প্রেসিডেন্টের হাতে থাকবে, ফলে বিচার বিভাগে জবাবদিহির ধারণা পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে।

সাংবিধানিক আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই সংশোধনী ‘পাকিস্তানের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণাটিকেই ধ্বংস করে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর মাধ্যমে দেশটি কার্যত আজীবন একনায়কতন্ত্রের পথে হাঁটছে।’ বিরোধীরা বলছেন, এই আইন সামরিক শাসনকে সংবিধানে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে এবং পাকিস্তানকে পূর্ণ কর্তৃত্ববাদে ঠেলে দিচ্ছে।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান কয়েক দশক সরাসরি সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। সে সময় জেনারেলরা সংবিধান স্থগিত করে দিয়েছিলেন। তবে ২০০৮ সালে জেনারেল পারভেজ মুশাররফের পতনের পর দেশটি এক ভঙ্গুর গণতন্ত্রে রূপ নেয়—যেখানে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারই মুখে নেতৃত্ব দেয়, কিন্তু পর্দার আড়ালে সেনাবাহিনীই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনী আবারও দেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মাধ্যমে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা আরও ক্ষমতাবান হচ্ছেন। ২০২২ সালে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর আসিম মুনির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কার্যত রাষ্ট্রপ্রধানের মতো সফর করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দুটি বৈঠক করেছেন, যেখানে ট্রাম্প তাঁকে ‘আমার প্রিয় ফিল্ড মার্শাল’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। সরকারি জোটের নেতা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা এই সংশোধনীকে ন্যায়বিচার ও সেনাবাহিনীর ‘আধুনিকীকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি’র উদ্যোগ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

অতীতে সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে সিনেট ও জাতীয় পরিষদে সপ্তাহজুড়ে বিতর্ক হতো। কিন্তু এবার তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুই কক্ষেই পাস হয়ে যায়। বিশ্লেষকদের মতে, দুর্বল জোট সরকারের অসহায়ত্ব এবং মুনিরের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবেরই প্রমাণ এটি। বুধবার কেবল চারজন সংসদ সদস্য বিলটির বিরোধিতা করেন।

পাকিস্তানের বৃহত্তম বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এই ভোট বর্জন করেছে। যদিও জনসমর্থনে দলটি এখনো শক্তিশালী, কিন্তু মুনির সেনাপ্রধান হওয়ার পর থেকে তাদের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাব প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। দলের নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন এবং তার মুক্তির সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

বহুদলীয় বিরোধী জোট তেহরিক-ই-তাহাফুজ-ই-আইন-ই-পাকিস্তান (টিটিএপি) অভিযোগ করেছে যে, সরকার ‘সংবিধানের ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছে।’ এক যৌথ চিঠিতে শতাধিক আইনজীবী ও অধিকারকর্মী এই সংশোধনীকে ‘সংবিধান বিকৃতি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তারা বলেন, এই প্রক্রিয়ায় ‘আইনজীবী সমাজ, বিচার বিভাগ এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে কোনো অর্থবহ আলোচনা বা মতবিনিময় হয়নি।’