Image description

এক সময় উট ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি ‘হেমেতি’ নামে বেশি পরিচিত, আজ সুদানের ক্ষমতার অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। তার নেতৃত্বে থাকা র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) দেশের প্রায় অর্ধেক অঞ্চলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে।

সম্প্রতি তারা দারফুরের শেষ সরকারি ঘাঁটি এল-ফাশ দখল করে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করেছে। শত্রুদের কাছে হেমেতি ভয়ঙ্কর, তবে তার সমর্থকেরা তাকে দৃঢ়তা, কঠোরতা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভাঙার প্রতিশ্রুতির প্রতীক হিসেবে দেখেন।

হেমেতি ১৯৭৪ বা ১৯৭৫ সালে দারফুরের এক যাযাবর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার মহারিয়া শাখার রিজেইগাত সম্প্রদায়ের, যারা ঐতিহ্যগতভাবে উট পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। দারিদ্র্য ও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বেড়ে ওঠা হেমেতি কৈশোরে স্কুল ছেড়ে উট ব্যবসায়ে যুক্ত হন। তিনি লিবিয়া ও মিসরের মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পণ্য বেচাকেনা করতেন। তখনকার দারফুর ছিল অবহেলিত, দরিদ্র ও আইনশৃঙ্খলাহীন, যা প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সরকারের নজর এড়িয়ে ছিল।

২০০৩ সালে ফুর জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহ শুরু হলে, বশির সরকার আরব মিলিশিয়া ‘জানজাওয়িদ’কে বিদ্রোহ দমনে পাঠায়। হেমেতি সেই বাহিনীর একটি ইউনিটের নেতৃত্ব দেন। জানজাওয়িদদের বিরুদ্ধে গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া, লুটপাট, ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ ওঠে। আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিবেদনে ২০০৪ সালে হেমেতির ইউনিট আদওয়া গ্রামে হামলা চালিয়ে ১২৬ জনকে হত্যা করে। মার্কিন তদন্তে জানজাওয়িদদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আসে। তবে হেমেতি তখন নীচের সারির কমান্ডার হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) নজরে আসেননি।

সংঘর্ষের বছরগুলোতে হেমেতি কৌশলে নিজের অবস্থান শক্ত করেন। তিনি শক্তিশালী আধাসামরিক বাহিনী, করপোরেট সাম্রাজ্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পান। বিদ্রোহের মাধ্যমে সেনা সদস্যদের বকেয়া বেতন, পদোন্নতি ও ভাইয়ের জন্য রাজনৈতিক পদ দাবি করে বশিরের সমর্থন অর্জন করেন। দারফুরের সবচেয়ে বড় স্বর্ণখনি ‘জাবেল আমির’ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ‘আল-গুনেইদ’কে সুদানের বৃহত্তম স্বর্ণ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বানান।

২০১৩ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএফের প্রধান হন, যা সরাসরি প্রেসিডেন্ট বশিরের অধীনে কাজ করত। জানজাওয়িদ বাহিনীকে আরএসএফের সঙ্গে একীভূত করে নতুন পোশাক, যানবাহন, অস্ত্র ও সেনা কর্মকর্তাদের সহায়তা দেওয়া হয়।

আরএসএফ দারফুরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দক্ষিণ সুদানের নুবা পর্বতমালায় বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলেও, লিবিয়া সীমান্তে মানবপাচার রোধের নামে চাঁদাবাজি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সুদানের সেনা পাঠানোর অনুরোধ করলে হেমেতি সুযোগটি কাজে লাগান।

তিনি সৌদি আরব ও ইউএই-এর সঙ্গে চুক্তি করে বাহিনীর সদস্যদের ভাড়াটে সেনা হিসেবে পাঠাতে শুরু করেন। আবুধাবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

টাকার প্রলোভনে অসংখ্য তরুণ সুদানি ও প্রতিবেশী দেশের যুবকরা আরএসএফ-এ যোগ দেয়। পরে তিনি রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলেন, যাতে প্রশিক্ষণ, স্বর্ণ ও বাণিজ্যিক চুক্তি অন্তর্ভুক্ত।

২০১৯ সালে বশির সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ তীব্র হলে, হেমেতির ইউনিটগুলো খারতুমে মোতায়েন হয়। বশির ভেবেছিলেন আরএসএফ সেনাবাহিনীকে অভ্যুত্থান ঠেকাতে পারে, কিন্তু হেমেতি ও অন্যান্য কমান্ডার বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হেমেতিকে সুদানের রাজনীতির নতুন মুখ হিসেবে প্রশংসা করা হয়। তবে অল্প সময়ের মধ্যে হেমেতি ও অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক পরিষদের যুগ্মপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান বেসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত করেন। গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন জোরদার হলে হেমেতি তার বাহিনী বিক্ষোভ দমন করতে নামান। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদনে বলা হয়, আরএসএফ সদস্যরা শত শত মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ ও পুরুষদের নীলনদে ফেলে দেয়। হেমেতি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে দুই বছর ধরে সামরিক ও বেসামরিক সরকার টালমাটাল সহাবস্থান চালায়। তবে একটি তদন্ত কমিটি সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা সংস্থা ও আরএসএফের মালিকানাধীন কোম্পানির আর্থিক লেনদেনের প্রতিবেদন প্রস্তুত করার ঠিক আগেই হেমেতি ও বুরহান যৌথভাবে বেসামরিক সরকারকে বরখাস্ত করে ক্ষমতা দখল করেন।

জোট দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বুরহান আরএসএফকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে হেমেতি রাজি হননি। ২০২৩ সালের এপ্রিল, আরএসএফ খারতুমে সেনা সদর দপ্তর ঘিরে ফেলে, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও জাতীয় প্রাসাদ দখলের চেষ্টা চালায়। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলেও, খারতুম ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।

দারফুরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই সংঘাতে ১৫ হাজার পর্যন্ত বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। আরএসএফ ও এর মিত্র মিলিশিয়া সুদানজুড়ে শহর, বাজার, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল লুটপাট করে; লুটকৃত পণ্য ‘দাগালো মার্কেট’-এ বিক্রি হচ্ছে।

যুদ্ধের প্রথম দিকে হেমেতি গুরুতর আহত হন। পুনরায় প্রকাশ্যে আসলেও তিনি যুদ্ধাপরাধ নিয়ে অনুশোচনা দেখাননি। বরং যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভের সংকল্প আরও দৃঢ় করেন।

আরএসএফের আধুনিক অস্ত্রের মধ্যে উন্নত ড্রোনও রয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব অস্ত্র ইউএই থেকে সুদানে প্রবেশ করছে।

হেমেতি এখন রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন, যার মধ্যে কিছু বেসামরিক গোষ্ঠী ও সশস্ত্র আন্দোলনও রয়েছে। ‘গভর্নমেন্ট অব পিস অ্যান্ড ইউনিটি’ নামে বিকল্প প্রশাসন গঠন করেছেন। এল-ফাশ দখলের পর নীলনদের পশ্চিমে প্রায় সব অঞ্চল আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে। 

 

বিশ্লেষকরা মনে করেন, হেমেতির দুটি সম্ভাব্য লক্ষ্য থাকতে পারে: নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা, অথবা পুরো সুদানের শাসনাধিকার লাভের স্বপ্ন দেখা। অন্যদিকে তিনি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, ভাড়াটে বাহিনী ও রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে আড়াল থেকে সুদানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

এল-ফাশেরের রাস্তায় বেসামরিক মানুষ হত্যা চললেও, হেমেতি আত্মবিশ্বাসী; তার মতে, আন্তর্জাতিক বিশ্বের এই নিষ্ঠুরতা থামাতে তেমন আগ্রহ নেই।