বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দুরাই পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (এসআইআর) বা বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে। সম্প্রতি এই প্রক্রিয়া ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যে আত্মহত্যা ও আত্মহত্যা চেষ্টা সংক্রান্ত একাধিক ঘটনাকে অনেকেই ‘এসআইআর আতঙ্কের’ ফল বলে মনে করছেন। এ খবর দিয়ে অনলাইন টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, বিভিন্ন এলাকার বহু নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে- ২০০২ সালের পর যেসব হিন্দু বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস শুরু করেছেন, তারাই সবচেয়ে উদ্বিগ্ন। ২০০২ সালকে রেফারেন্স বছর ধরে করা হচ্ছে এই এসআইআর। তাই এর পর যারা এসেছেন, তাদের নাম ভোটার তালিকায় রাখতে হলে নির্দিষ্ট নথিপত্র দেখাতে হবে। কোন্নগরের নবপল্লির এক ৬৩ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী বলেন, তিনি ২০০২ সালে স্ত্রী ও দুই ছোট সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান। গত ২৩ বছরে তারা ভোটার কার্ড, আধার, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং জমির দলিলসহ সব ধরনের নথি সংগ্রহ করেছেন। মেয়ে বিবাহিত, ছেলে বিদেশে কর্মরত। তবু তার কথায়, আমাদের নাম ২০০২ সালের তালিকায় নেই। তাই এখন রাতের ঘুম উড়ে গেছে। নেতারা নানা রকম কথা বলছেন। কেউ বলছেন সিএএ আছে, কেউ বলছেন নেই। এখন যদি স্কুলের সার্টিফিকেট বা জন্মনিবন্ধন চাওয়া হয়, আমরা কোথায় পাব? বাংলাদেশে তো এসব কাগজ এখন আর নেই।
এসআইআর-এর নিয়ম অনুযায়ী, যাদের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নেই, তাদেরকে নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট তালিকায় উল্লিখিত প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। কোন্নগরের আরেক বাসিন্দা বলেন, আমরা ২০০৩ সালে বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ২০০৮ সালে ভোটার কার্ড পেয়েছি। এখন এত অল্প সময়ে কীভাবে ওই সব প্রমাণপত্র জোগাড় করব? বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বহু হিন্দু এখন রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে আছেন। তাদের মধ্যে বড় অংশেরই আশঙ্কা, এসআইআর প্রক্রিয়ায় তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যেতে পারে। বিজেপি নেতারা এই ভয় কাটানোর চেষ্টা করছেন।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, বাংলাদেশি হিন্দুদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারা অনুপ্রবেশকারী নন, বরং প্রাণ বাঁচাতে ভারতে এসেছেন। যদি তাদের নাম ২০০২ সালের তালিকায় না থাকে, তাহলে তারা সিএএ’র মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। বিজেপি তাদের সাহায্য করবে। তবে অনেকেই এতে আশ্বস্ত নন। এই ভয়ের প্রভাব পড়েছে পুরো মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে। শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন-এর জাতীয় সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় মল্লিক বলেন, বিজেপি বলছে, মতুয়ারা হিন্দু বলে তাদের কিছু হবে না। কিন্তু এসআইআর শুরু হলে কেউই যাচাই প্রক্রিয়া থেকে বাঁচবে না।
উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ায় সংগঠনটি সম্প্রতি এসআইআর বিরোধী এক বিক্ষোভ র্যালির আয়োজন করে। তাতে প্রায় ৩,০০০ মানুষ অংশ নেন। মতুয়ারা কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে গিয়ে ভারতে বসতি গড়েছেন এবং ভোটও দেন। কিন্তু অনেকের নামই ২০০২ সালের তালিকায় নেই, আর এসআইআর-এর জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রও তাদের কাছে নেই। রাজ্যে প্রায় ৪০টি আসনে মতুয়াদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০টি আসনে তারা নির্বাচনের ফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারেন। তাই এই অসন্তোষ রাজনৈতিকভাবে বড় ইঙ্গিত বহন করছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছে, আগামী তিন মাসে এসব এলাকায় ৭০০টিরও বেশি সিএএ ক্যাম্প আয়োজন করতে, যাতে এসআইআর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন।
কিন্তু আশঙ্কা এখনো কাটেনি। হরিনঘাটার বিজেপি বিধায়ক অশিম সরকার বলেন, সিএএ অনুযায়ী, যারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন, কেবল তারাই নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য। ২০১৪ এর পর যারা এসেছেন, তারা সিএএ’র আওতায় পড়বেন না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি নেতা শান্তনু ঠাকুর মতুয়া সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসংঘ-এর পরিচয়পত্র বিতরণ করছেন, দাবি করে যে তা নাগরিকত্বের বৈধ প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হবে। তবে সেই দাবি বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার মতুয়া স্বপন গোসাই বলেন, বিহারে অনুষ্ঠিত এসআইআর প্রক্রিয়ায় কোনো ধর্মীয় সংগঠনের দেয়া আইডি কার্ড গ্রহণযোগ্য দলিল হিসেবে ধরা হয়নি।
ঠাকুরনগরের গণপতি বিশ্বাস জানান, আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছি- মতুয়া মহাসংঘের কার্ডগুলো কি বৈধ নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরা হবে? এখনো কোনো উত্তর পাইনি। বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার রবি ঢালি বলেন, আমাদের এলাকায় শত শত মতুয়া আতঙ্কে আছেন। কারণ ২০০২ সালের তালিকায় তাদের বা তাদের বাবা-মায়ের নাম নেই। অথচ আমরা ভোটার কার্ড, রেশন কার্ডসহ বছরের পর বছর ভোট দিয়ে যাচ্ছি। যদি একটিও নাম বাদ পড়ে, বড় ধরনের আন্দোলন হবে।