গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া সম্ভব হতো না- জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেসকা আলবানিজের এমন মন্তব্যে নড়েচড়ে বসেছে বিশ্বরাজনীতি।
সোমবার প্রকাশিত তার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ‘গাজা জেনোসাইড: এ কালেক্টিভ ক্রাইম’-এ তিনি বলেন, এই হত্যাযজ্ঞের দায় শুধু ইসরায়েলের নয়; যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও আরব বিশ্বের ৬৩টি দেশ যৌথভাবে এই অপরাধে জড়িত
২৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে আলবানিজ উল্লেখ করেন, গাজার ধ্বংসযজ্ঞ মূলত একটি ‘সমষ্টিগত অপরাধ’, যা রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তার মাধ্যমে টিকে আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কূটনৈতিক সুরক্ষা না থাকলে ইসরায়েল এতদিন দায়মুক্তভাবে এমন ভয়াবহ হামলা চালাতে পারত না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আলবানিজ বলেন, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো শুধু ইসরায়েলকে রক্ষা করেই থেমে থাকেনি, তাদের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বক্তব্যেও এমন প্রচারণা ছড়ানো হয়েছে যা ইসরায়েলকে ‘সভ্য রাষ্ট্র’ ও ফিলিস্তিনিদের ‘বর্বর জাতি’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। হামাস ও সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কোনো পার্থক্য না রেখে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ইসরাইলি বয়ান হুবহু পুনরাবৃত্তি করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অন্তত সাতবার ভেটো প্রয়োগ করে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বাধাগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে ইসরায়েলকে কূটনৈতিক সুরক্ষা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসও বিভিন্ন প্রস্তাব দুর্বল বা বিলম্বিত করে ওয়াশিংটনের অবস্থানকে সহায়তা করেছে।
আরব ও মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। মিসর রাফাহ সীমান্ত বন্ধ রেখেছে এবং ইসরাইলের সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহ বজায় রেখেছে। কিছু আঞ্চলিক দেশ ইসরায়েলের জন্য বিকল্প স্থলপথ খুলে দিয়ে লোহিত সাগর এড়িয়ে বাণিজ্য সহজ করেছে।
আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রেও পশ্চিমাদের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন আলবানিজ। তিনি জানান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিকারাগুয়া ইসরায়েলবিরোধী মামলা করার পর অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তা সমর্থন করেনি; বরং এখনো পর্যন্ত ইসরায়েলের গণহত্যা চালানোর বিষয়টি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র আদালতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং যুক্তরাজ্য অর্থায়ন বন্ধের হুমকি দিয়েছে, যাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে না পারে।
আলবানিজের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে জাতিসংঘ ইসরায়েলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালি ইসরাইলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে রয়ে গেছে। ওয়াশিংটন প্রতিবছর ৩.৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, পাশাপাশি ২০২৮ সাল পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কর্মসূচির জন্য আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাজ্যও ৬০০-র বেশি নজরদারি বিমান পাঠিয়ে সামরিক সহযোগিতা জোরদার করেছে।
এ ছাড়া অন্তত ২৬টি দেশ ১০ দফায় ইসরায়েলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান পাঠিয়েছে। তাদের মধ্যে চীন (তাইওয়ানসহ), ভারত, ইতালি, অস্ট্রিয়া, স্পেন, চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া ও ফ্রান্স উল্লেখযোগ্য। ১৯টি দেশ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে—তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশ।
যদিও স্পেন ও স্লোভেনিয়া অস্ত্রচুক্তি বাতিল করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ এখনো তা অব্যাহত রেখেছে। ইতালি, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স ও মরক্কো তাদের বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে ইসরায়েলকে অস্ত্র পাঠাতে অনুমতি দিয়েছে।
অন্যদিকে গাজায় যুদ্ধ চলার সময়ও ইসরাইলের সামরিক রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে থেকে গেছে। জার্মানি, পোল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স ও সার্বিয়া যুদ্ধকালেও ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়িয়েছে।
আরব বিশ্বের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, জর্ডান ও মরক্কোও ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে। কেবল তুরস্ক ২০২৪ সালের মে মাসে সম্পর্ক স্থগিত করলেও কিছু পরোক্ষ বাণিজ্য তখনও চলেছে।
প্রতিবেদনের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৬৮ হাজার ২০০-র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। যুদ্ধের ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে অঞ্চলটি।
আলবানিজ আরও জানান, ইসরায়েলের অভিযোগে ১৮টি দেশ জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ ও কর্মসংস্থানের সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর তহবিল স্থগিত করেছিল। তদন্ত অসম্পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও পরে কিছু দেশ তহবিল পুনরায় চালু করে।
তার ভাষায়, ‘কিছু রাষ্ট্র ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে আসল সমস্যা থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করছে, যা বিপজ্জনক ও অকার্যকর।’
তিনি আরও বলেন, ‘গাজায় গণহত্যার ভয়াবহতা স্পষ্ট হওয়ার পরও অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ ইসরাইলকে সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা দিতে থাকে।’