
বয়সজনিত কারণে দৃষ্টিশক্তি হারানো মানুষদের নতুন আশা দেখাচ্ছে এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) ও মুরফিল্ডস আই হাসপাতালের গবেষকেরা এমন একটি মাইক্রোচিপ আবিষ্কারের দাবি করেছেন, যা চোখের পেছনের অংশে প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব। এ চিপটি এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তিতে চলবে। এর নাম দেওয়া হয়েছে, প্রিমা ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) রেটিনাল ইমপ্ল্যান্ট।
গতকাল সোমবার দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন সাময়িকীতে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে।
ইউরোপে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যেসব মানুষ এজ-রিলেটেড ম্যাকুলার ডিজেনারেশন বা সংক্ষেপে এএমডি জনিত কারণে চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি হারিয়েছিলেন, তাদের ৮৪ শতাংশই এই নতুন চিপ প্রতিস্থাপন করে আবার অক্ষর, সংখ্যা এবং শব্দ চিনতে পেরেছেন। সাধারণত বয়স্ক মানুষেরা এএমডিতে ভুগে থাকেন। এএমডির কারণে সৃষ্ট জিওগ্রাফিক অ্যাট্রোফি (জিএ) নামের চক্ষুরোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় এ চিপটি কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই ড্রাই এএমডি রোগে আক্রান্ত। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাদের এই রোগটি হয়, তাদের চোখের পেছনের অংশে রেটিনার একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের কোষ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় ও মারা যায়। এতে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা বা বিকৃত হয়ে যায়। প্রিমাা প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এ ধরনের রোগীরা আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ইউসিএল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজির সহযোগী অধ্যাপক ও মুরফিল্ডস আই হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ সার্জন মাহি মুকিত বলেন, ‘কৃত্রিম দৃষ্টির ইতিহাসে এটি এক নতুন অধ্যায়। অন্ধ মানুষেরা এখন সত্যিকার অর্থে আবার কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ফিরে পাচ্ছেন—যা আগে কখনো সম্ভব হয়নি।’
জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফ্র্যাঙ্ক হোলৎস গবেষণাটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাঁচটি দেশের ১৭টি জায়গার ৩৮ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি চালানো হয়েছে। ৩৮ জনের মধ্যে ৩২ রোগীর চোখে চিপটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২৭ জন তাঁদের কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ব্যবহার করে আবারও পড়তে পেরেছেন। এর এক বছর পর দেখা গেছে, এসব রোগী দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার জন্য ঝুলিয়ে রাখা চার্টের ২৫টি অক্ষর বা পাঁচটি লাইন পড়তে পারছেন।
জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফ্র্যাঙ্ক হোলৎস গবেষণাটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাঁচটি দেশের ১৭টি জায়গার ৩৮ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি চালানো হয়েছে। ৩৮ জনের মধ্যে ৩২ রোগীর চোখে চিপটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২৭ জন তাঁদের কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ব্যবহার করে আবারও পড়তে পেরেছেন। এর এক বছর পর দেখা গেছে, এসব রোগী দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার জন্য ঝুলিয়ে রাখা চার্টের ২৫টি অক্ষর বা পাঁচটি লাইন পড়তে পারছেন।
প্রিমা চিপটি একটি তারবিহীন সাবরেটিনাল ফোটোভোল্টাইক ইমপ্ল্যান্ট। এটি সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিয়ে কাজ করে। এর পুরুত্ব মানুষের চুলের অর্ধেক। ক্যালিফোর্নিয়া বায়োটেক সায়েন্স করপোরেশন এটি তৈরি করেছে।
মুরফিল্ডস আই হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ সার্জন মাহি মুকিত বলেন, ড্রাই এএমডির এখনো কোনো অনুমোদিত চিকিৎসা নেই। তাই এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে আরও নানা ধরনের চোখের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হতে পারে। তবে শুধু চিপ বসালেই দেখা যাবে না—এর ব্যবহার শেখাও বড় ব্যাপার।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাঁরা আগে অন্ধকারে ছিলেন, তাঁরা এখন আবার মুখ চিনতে, পড়তে, এমনকি হাঁটাচলা করতেও সক্ষম হচ্ছেন। তাদের জীবনে আলো ফিরেছে, আর তার কেন্দ্রে আছে বিজ্ঞান।’
কীভাবে কাজ করে এই চোখ
এ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রোপচার করে চোখের রেটিনার নিচে ক্ষুদ্র আকারের একটি চিপ বসানো হয়। চোখ সেরে ওঠার পর রোগী বিশেষ ধরনের চশমা পরেন। চশমায় ছোট্ট একটি ভিডিও ক্যামেরা থাকে। এর প্রসেসরটি রোগীর পকেটে থাকে। চশমার ক্যামেরা চারপাশের দৃশ্য ধারণ করে ইনফ্রারেড আলোক রশ্মি আকারে সেই ছবি চিপে পাঠায়। চিপটি সৌরপ্যানেলের মতো কাজ করে। এআই অ্যালগরিদম সেই ডেটাকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে চোখের স্নায়ু ও অপটিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। এরপর মস্তিষ্ক সেই সংকেতগুলোকে ছবিতে পরিণত করে। এভাবেই দৃষ্টিহীন মানুষ আবার ‘দেখতে’ পারেন।
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোগীরা শেখেন কীভাবে চশমা ব্যবহার করে লেখাগুলো স্ক্যান করতে হয় ও জুম বাড়িয়ে ছোট অক্ষর পড়তে হয়। কয়েক মাসের অনুশীলনে তাঁরা নতুন এই “কৃত্রিম দৃষ্টি”র ভাষা বুঝতে শিখেন।
৬৮ বছর বয়সী শিলা আরভিন মুরফিল্ডসের এক রোগী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হতো, চোখের ভেতরে যেন দুইটা কালো চাকতি আছে। বই পড়া আমার নেশা ছিল, তাই গবেষণায় অংশ নিতে চেয়েছিলাম। অপারেশনে ব্যথা হয়নি, কিন্তু মনে হচ্ছিল নতুনভাবে চোখের ভেতর দিয়ে দেখছি। প্রথমবার যখন একটা অক্ষর দেখলাম, সত্যি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমি ছোট লেখা পড়তে চেষ্টা করি, ক্রসওয়ার্ড করি। এটা আমার জীবনে বিশাল পরিবর্তন এনেছে। পড়া মানে আরেক দুনিয়ায় প্রবেশ করা—এখন আমি অনেক বেশি আশাবাদী।