Image description
 

নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে দেখা যাচ্ছে এক অজ্ঞাত স্থান থেকে বক্তব্য দিতে, ভেনিজুয়েলার কারাকাসে ১৩ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে জুমে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে [এএফপি]।

 

হোয়াইট হাউস ‘শান্তির বদলে রাজনীতি বেছে নেওয়া’র অভিযোগ তুলে নোবেল কমিটিকে তাৎক্ষণিকভাবে সতর্ক করেছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল না দিয়ে তা ভেনিজুয়েলার মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে দেওয়া হয়। তবু প্রশাসনের জন্য বিষয়টা পুরোপুরি অস্বস্তিকর ছিল না। কারণ ট্রাম্প আর মাচাদো একই ডানপন্থি কর্তৃত্ববাদী ভাবধারার মানুষ। তাই ট্রাম্প দ্রুত তাকে অভিনন্দন জানান, আর মাচাদোও পাল্টা তার পুরস্কারটি ট্রাম্পকে উৎসর্গ করেন।

ভেনিজুয়েলার কট্টর ডানপন্থি বিরোধী শিবিরের নেতা হিসেবে মাচাদো বহু বছর ধরে এমন এক ধরনের ‘শান্তি’র কথা বলে আসছেন, যা মূলত দেশটির গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব দুর্বল করার পথে কাজ করেছে। ২০০২ সালে তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। সেই ব্যর্থতার পরও তিনি এমন এক বিরোধী জোট গড়ে তোলেন, যার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে দেশটিকে আবারও ধনীদের শাসনে ফিরিয়ে নেওয়া। এজন্য তিনি সড়ক অবরোধ, সহিংসতা, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ, অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি—সবকিছুই সমর্থন করেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার তথাকথিত ‘শান্তির মিশন’ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তিনি প্রকাশ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে আহ্বান জানান ভেনিজুয়েলাকে বোমা মারতে, যেন দেশটি ‘মুক্ত’ হয়।

মাচাদোর এই উত্থানে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহলের বড় ভূমিকা আছে। তারা তাকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তুলে ধরেছে, যেন তিনি গণতন্ত্র রক্ষার প্রতীক। আসলে তার ভাবমূর্তিটা খুব সচেতনভাবে সাজানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের স্বাদ অনুযায়ী—যেখানে এখন ডানপন্থি জনতাবাদীরা নিজেদের গণতন্ত্র রক্ষাকারী হিসেবে উপস্থাপন করছে। মাচাদোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার মধ্য দিয়ে কমিটি সেই সাজানো চিত্রকেই আরও চকচকে করেছে, যেন পশ্চিমই একমাত্র সংজ্ঞা দেয়—গণতন্ত্র কাকে বলে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই পুরস্কার শুধু ভুল মানুষকে দেওয়া হয়নি, বরং এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনকে নতুন করে লাতিন আমেরিকায় সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে ভেনিজুয়েলার জন্য সহিংস শাসন পরিবর্তনের সম্ভাবনা এখন খুবই বাস্তব।

মাচাদো নিজেও ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই নোবেল পুরস্কারের ফলে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বাড়তে পারে। এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর কলামনিস্ট ব্রেট স্টিফেনসও। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ মাচাদো ট্রাম্পের তথাকথিত ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধ’কে সমর্থন করেছেন, তার সামরিক হুমকিকেও উৎসাহ দিয়েছেন, এমনকি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার পক্ষেও কাজ করেছেন—যে নিষেধাজ্ঞাগুলো ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি ভেঙে দিয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষকে কষ্টে ফেলেছে।

এই আশঙ্কা ইতিমধ্যেই সত্যি হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি গোপন সিআইএ অভিযান অনুমোদন করেছে ভেনিজুয়েলার সরকার অস্থিতিশীল করতে। এতে স্পষ্ট হলো, মাচাদোকে ‘শান্তি’র প্রতীক হিসেবে পুরস্কৃত করা আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে উল্টোভাবে যুদ্ধের নৈতিক অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ, যে নোবেল পুরস্কার যুদ্ধ বন্ধে দেওয়া হয়, তা এবার যুদ্ধের যুক্তি হয়ে উঠেছে।

অন্যভাবে বলা যায়, মাচাদোকে নোবেল দেওয়া শুধু শান্তির ধারণাকেই অপমান করেনি, বরং ট্রাম্পের সেই রাজনীতিক কৌশলকেই বৈধতা দিয়েছে, যেখানে সহিংসতাকে ‘শান্তি’ বলা হয়। এই বিকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা এর বিরোধিতা করে তারা হয়ে ওঠে ‘স্বাধীনতার শত্রু’—আর তাদের নির্মূল করাকেই বলা হয় ‘গণতন্ত্র রক্ষা’।

এই প্রক্রিয়ায় মাচাদো ও ট্রাম্পের লক্ষ্য প্রায় একই। উভয়েরই উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতা ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত রাখা, এমন অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা যা ধনীদের আরও ধনী করে, আর সাধারণ মানুষকে আরও প্রান্তিক করে তোলে। প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসম্পদে সরকারের ভূমিকা কমিয়ে আনার মধ্য দিয়ে তারা ধনীদের মুনাফার পথ প্রশস্ত করে।

তাই মাচাদোর মতো একজন নেত্রীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া শুধু ভেনিজুয়েলার জন্য নয়, পুরো লাতিন আমেরিকা—এমনকি বিশ্বের জন্যও গভীরভাবে উদ্বেগজনক। কারণ এতে বার্তা যায়, সহিংসতা, সামরিক হস্তক্ষেপ ও আর্থিক দমননীতিই যদি পশ্চিমের কাছে ‘শান্তি’ হয়ে ওঠে, তবে সত্যিকারের শান্তির কোনো মানে থাকে না।

স্টিভ স্ট্রিফলার যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়, বোস্টনের লেবার রিসোর্স সেন্টারের পরিচালক এবং নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি Solidarity: Latin America and the US Left in the Era of Human Rights (প্লুটো, ২০১৯) গ্রন্থের লেখক।