
গত সপ্তাহান্তে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষে দুই পক্ষের প্রায় ২৫০ জন নিহত হন। সীমান্তে এই সংঘর্ষ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যদিও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই বৈরীভাব নতুন নয়। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে ভরা জনসমাবেশে, এক লাখ মানুষের সামনে গুলি করে হত্যা করেছিলেন এক আফগান।
দিনটি ছিল ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে চার বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করেছে পাকিস্তান। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি জনসভায় ভাষণ দেবেন, জনগণের সামনে নিজের দেশ পরিচালনা নীতির ব্যাখ্যা দেবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে সারা দেশ থেকে দলে দলে মানুষ রাওয়ালপিন্ডি আসছিলেন। পাকিস্তান মুসলিম লিগ (রাওয়ালপিন্ডি) ওই জনসমাবেশের আয়োজন করেছিল।
ভাষণে প্রধানমন্ত্রী কী বলবেন, তা জানতে যেমন সেদিন দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, তেমনি লিয়াকত আলী নিজেও জনগণকে বিস্ময় উপহার দিতে চেয়েছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি রওনা হওয়ার আগে স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, এটা হবে একটি নীতিনির্ধারণী ভাষণ।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে লিয়াকত আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশটির জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ডান হাত বলে পরিচিত ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তার কমতি ছিল না।
তারপরও কেন লিয়াকত আলী খানকে খুন হতে হলো, সে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।
লিয়াকত আলী খানের হত্যাকাণ্ড ঘিরে সে সময় সবচেয়ে বেশি রহস্যময় আচরণ করেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ঠিক কী কারণে, কার ইশারায় জনপ্রিয় এই প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে খুন হতে হলো, তা খুঁজে বের করা নিয়ে তাদের মধ্যে ‘অনীহা’ দেখা গিয়েছিল।
দেশে-বিদেশে অনেক সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক এ রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করছেন। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বও আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান হত্যা রহস্যের কিনারা কেউ করতে পারেনি।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর, রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগ সকাল থেকে জনারণ্য। বিকেলে সেখানে বক্তৃতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সমাবেশ ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে কোম্পানিবাগে প্রায় এক লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।
যেদিন খুন হন
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর, রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগ সকাল থেকে জনারণ্য। বিকেলে সেখানে বক্তৃতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সমাবেশ ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে কোম্পানিবাগে প্রায় এক লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।
বিকেল চারটার দিকে সমাবেশস্থলে আসেন প্রধানমন্ত্রী। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চে বক্তৃতা দিতে ওঠেন তিনি।
সেদিনের সেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল লিয়াকত আলীর ব্যক্তিগত নির্দেশে। তিনি আয়োজকদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, তিনি যখন ভাষণ দেবেন, তখন মঞ্চে তাঁর পাশে আর কেউ থাকবে না। মঞ্চে তিনি একা থাকবেন এবং মঞ্চের ওপর কোনো শামিয়ানা থাকবে না।
সারা দেশ থেকে অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগীর পাঠানো চিঠির জেরে লিয়াকত আলী এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন। চিঠিতে সবাই অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে নিজ চোখে ভালো করে দেখতে চান।
তাই মঞ্চের ওপর রাখা হয়েছিল একটি মাইক্রোফোন, একটি চেয়ার ও একটি টেবিল। মঞ্চের উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে চার ফুট।
কে জানতে, এভাবে অনুসারীদের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে লিয়াকত আলী খুনির সহজ নিশানায় পরিণত হবেন। মঞ্চে উঠে সবে তিনি বলেছেন ‘বেরাদারান-ই-মিল্লাত’...।
তখনই পরপর দুটি গুলির শব্দ, উপস্থিত জনতা দেখলেন মঞ্চের ওপর ঢলে পড়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। সে নীরবতা ভাঙে তৃতীয় গুলির শব্দে।
লোকজন ছুটতে শুরু করেন, সবার মুখে এক কথা, ‘কায়েদ-ই-মিল্লাত মারা গায়া’ (প্রধানমন্ত্রী মারা গেছেন)।
হামলাকারীর ছোড়া একটি গুলি লিয়াকত আলীর বুকের বাঁ পাশে লাগে। তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়, করা হয় অস্ত্রোপচার। কিন্তু তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তখন লিয়াকত আলীর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার পর কোম্পানিবাগের নাম বদলে রাখা হয় লিয়াকত গার্ডেন। লিয়াকত আলী খুন হওয়ার ঠিক ৫৬ বছর পর ২০০৭ সালে এই লিয়াকত গার্ডেনেই গুপ্তহত্যার শিকার হন পাকিস্তানের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো।
লিয়াকত আলীর আফগান খুনি
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়া নিয়ে ভারতীয় লেখক এম এস ভেঙ্কটারমনি তাঁর বই ‘দ্য আমেরিকান রোল ইন পাকিস্তান’–এ লেখেন, লিয়াকত আলী খানের খুনির ছোড়া একটিমাত্র বুলেট দেশটির রাজনীতির পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে প্রমাণিত হয়।
লিয়াকত হত্যাকাণ্ডের পরপরই পাকিস্তানি কর্মকর্তারা সাঈদ আকবর বাবরাক নামে একজনকে প্রধানমন্ত্রীর খুনি বলে ঘোষণা করেন। শুরুতে সংশয় থাকলেও পর তাঁরা বলেন, সাঈদ আফগানিস্তানের নাগরিক।
কিন্তু আফগান সরকার পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ওই দাবি অস্বীকার করে। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য সাঈদের আফগান নাগরিকত্ব আগেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তাঁরা।
সাঈদ ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে অবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। সে সময়ের ব্রিটিশ শাসকেরা সাঈদকে শরণার্থীর মর্যাদা দিয়ে নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখাওয়া) আশ্রয় দেন। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থী হিসেবে সাঈদকে ভাতা দেওয়া হচ্ছিল।
ঘটনাস্থলেই কেন হত্যা করা হয় হামলাকারীকে
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মঞ্চের ঠিক উল্টো দিকে দর্শক আসনের একেবারে সামনের সারি থেকে গুলি চালিয়েছিলেন সাঈদ। দর্শক আসনের ওই সারি রাখা ছিল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) কর্মকর্তাদের জন্য। একজন সাধারণ মানুষ হয়ে সাঈদ সেখানে কীভাবে পৌঁছালেন?
সাঈদ প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার পরপর আশপাশের লোকজন তাঁর ওপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়। হাজারো আঘাতের সঙ্গে সাঈদের মৃতদেহে তিনটি গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। ভিড়ের মধ্যে কে সাঈদকে গুলি করে?
পরে সেখানে উপস্থিত এক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেন, তাঁর ছোড়া অন্তত একটি গুলি সাঈদের গায়ে লেগেছে। একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি খুনিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছেন।
তাঁদের কেউই লিয়াকত আলী খানকে নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এমনকি আমি তাঁদের কারও মুখ থেকে সমবেদনা বা দুঃখ প্রকাশ করে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে শুনিনি।..আইয়ুব খান
ঘটনাস্থলে হামলাকারীর মৃত্যু লিয়াকত হত্যারহস্য জটিল করে তোলে
সে সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বলা হয়, গণপিটুনি থেকে বাঁচিয়ে সাঈদকে জীবিত আটকের সুযোগ পুলিশের হাতে ছিল। সাঈদের মৃত্যু লিয়াকত হত্যারহস্যকে গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেয়। প্রশ্ন ওঠে, সাঈদকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খুন করার পর মুখ বন্ধ করতে তাঁকেও কি ঘটনাস্থলে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়?
হত্যার পর সাঈদের পকেটে প্রায় ২ হাজার রুপি পাওয়া যায়। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে তাঁর বাড়ি তল্লাশি করে পাওয়া যায় আরও ১০ হাজার রুপি। তখনকার প্রেক্ষাপটে এটা বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। সাঈদের কাছে এত রুপি পাওয়ায় কেউ কেউ ধরে নেন, তিনি ভাড়াটে খুনি ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীকে খুন করতেই তাঁকে ভাড়া করা হয় এবং মুখ বন্ধ করতে তাঁকেও ঘটনাস্থলে হত্যার বন্দোবস্ত করেন চক্রান্তকারীরা।
যদিও এমন ধারণার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

লিয়াকত হত্যা নিয়ে যত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
কার ইশারায়, কী কারণে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন লিয়াকত আলী খান, তা নিয়ে বেশ কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পাওয়া যায়। অনেকের মতে, তাঁকে হত্যার পেছনে বিদেশি শক্তির হাত ছিল। কেউ কেউ বলেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল।
লিয়াকতের কমিউনিস্টবিরোধী ও পশ্চিমাপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকেরা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র লিয়াকতকে খুন করিয়েছে।
লিয়াকত হত্যার ৬৪ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক গোপন নথি প্রকাশ পায়। সেখানে দাবি করা হয়, তৎকালীন আফগান সরকারের সহায়তায় লিয়াকত আলীকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।
ওই নথিতে আরও দাবি করা হয়, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে ইরানে তেল-সংশ্লিষ্ট চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য লিয়াকত আলী খানকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় লিয়াকতের সঙ্গে ইরানের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু লিয়াকত যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি হননি; বরং তিনি পাকিস্তান থেকে মার্কিন বিমান ঘাঁটি সরানোর দাবি তোলেন। এ কারণে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে সিআইএ।
কেউ কেউ আবার খুনি সাঈদ আকবরের ব্যক্তিগত ক্ষোভের কথাও বলেন। সাঈদ আফগান পশতু ছিলেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকতের মৃত্যু একটি ঐক্যবদ্ধ পাখতুনিস্তান (পশতুনিস্তান) গঠনের পথ প্রশস্ত করতে সহায়তা করবে।
এসব তত্ত্বের কোনোটিই কেউ প্রমাণ করতে পারেনি।
তদন্ত কর্মকর্তার রহস্যজনক মৃত্যু
লিয়াকত আলী খান হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার ছিল নবাবজাদা এইতজাজউদ্দিনের হাতে। নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্ক জানাতে তিনি আকাশপথে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু পথে বিমানের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায় এবং সেটি বিধ্বস্ত হয়। সব আরোহী মারা যান। সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায় তদন্তের সব নথিপত্রও।
সংবাদমাধ্যমের রহস্যজনক ভূমিকা
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত হত্যার খবর প্রকাশ নিয়ে সে সময় পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলো রহস্যজনক আচরণ করেছিল। তারা হত্যার কারণ না খুঁজে সন্দেহভাজন খুনি সাঈদের ওপর খবর প্রকাশে বেশি মনোযোগ দেয়।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেই সময় পাকিস্তান সরকার থেকে দেওয়া নানা বিবৃতিও ছিল পরস্পরবিরোধী। যে কারণে সরকারের ওপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যায়।
পরদিন পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত খবরও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিকেল প্রায় সাড়ে চারটার দিকে গুলি খান প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে হাসপাতালে নিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় নেওয়া হয়। হাসপাতালে নিতে দেরি হওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা আরও গুরুতর হয়ে পড়েছিল।
তখনই পরপর দুটি গুলির শব্দ, উপস্থিত জনতা দেখলেন মঞ্চের ওপর ঢলে পড়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। সে নীরবতা ভাঙে তৃতীয় গুলির শব্দে।
হাসপাতালে নেওয়ার আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে মারা যান প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ সন্ধ্যার মধ্যেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু পরদিন দেশের বেশির ভাগ জাতীয় দৈনিকে লিয়াকতের অবস্থা নিয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য জনগণ পায়নি।
ওই সময়ে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত পাকিস্তানের দুই শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র দৈনিক ইমরোজ (করাচি) ও দৈনিক জমিদার (লাহোর) প্রধানমন্ত্রীকে গুপ্তহত্যা নিয়ে কোনো খবর প্রকাশ করেনি।
১৭ অক্টোবর ১৯৫১ সালে ডেইলি পাকিস্তান টাইমস অথবা ডেইলি সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেটে আগের দিনের ঘটনা নিয়ে কোনো ছবি ছাপা হয়নি।
তবে কি পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয় কিছু আড়াল করতে চেয়েছিল? কেন ১৬ অক্টোবরের ঘটনার ছবি জনগণের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল?
লিয়াকত হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে কি তাহলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গোপন আঁতাত ছিল?
সে সময় ওঠা এমন আরও অনেক প্রশ্নের জবাব আজও পাওয়া যায়নি।
আইয়ুব খানের স্মৃতিকথা
পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁর স্মৃতিকথা ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ বইয়ে লিয়াকত আলী খান হত্যা–পরবর্তী পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। মেজর জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রথম সেনাপ্রধান। লিয়াকত আলী খান তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
আইয়ুব খান তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘পাকিস্তানে ফিরে আমি করাচির নতুন মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন (নতুন) প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, মুস্তাক আহমদ গুরমানিসহ আরও কয়েকজন। তাঁদের কেউই লিয়াকত আলী খানকে নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এমনকি আমি তাঁদের কারও মুখ থেকে সমবেদনা বা দুঃখ প্রকাশ করে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে শুনিনি।’
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার সময় আইয়ুব খান লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
পাকিস্তানে ফিরে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের আচরণ দেখে আইয়ুব খানের মনে হয়েছিল, দেশের একজন প্রখ্যাত ও যোগ্য প্রধানমন্ত্রী যে খুন হয়েছেন, সেই সত্যের বিষয়ে তিনি যেন কিছুই অবগত নন।
প্রধানমন্ত্রী খুন হওয়া তাঁদের পেশাজীবনে নতুন এক সূচনা এনে দিয়েছিল বলেই মনে হয়েছিল আইয়ুব খানের।
আইয়ুব খান আরও লেখেন, ‘এটা ঘৃণ্য ও বিদ্রোহপূর্ণ ছিল। এটি হয়তো কঠোর শোনাবে, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, তাঁরা সবাই যেন স্বস্তি বোধ করছেন। মনে হচ্ছিল, তিনি (লিয়াকত আলী) একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি তাঁদের শাসনে রাখতে পারতেন। এখন তিনি দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছেন।’
এরপর সময় অনেক গড়িয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে পাকিস্তান ও দেশটির সরকার আর বের হতে পারেনি। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী নিজের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। মেয়াদ শেষের আগেই তাঁদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র: দ্য ডন, ব্রিটানিকা, কোরা ডটকম, দ্য পাকিস্তান টাইমস (লাহোর)