Image description

গাজায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মধ্যপ্রাচ্য সফরে এ অঞ্চলের আরেকটি সংকটের দিকে নজর দিয়েছেন। আর তা হলো, তেহরান–ওয়াশিংটন সম্পর্কের উত্তেজনা বা টানাপোড়েন।

সোমবার ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য এক চুক্তি নিয়ে তিনি ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়াতে চান।

বছরের মাঝামাঝি ১২ দিনের ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যে ট্রাম্প প্রথমবারের মতো তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় বোমাবর্ষণের নজির স্থাপন করেন।

‘আমরা প্রস্তুত, যখন তোমরাও প্রস্তুত হবে। এটাই হবে ইরানের নেওয়া সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত এবং এটি ঘটবেই’, তেহরানের সঙ্গে সম্ভাব্য এক চুক্তি নিয়ে বলেন ট্রাম্প। তিনি আরও বলেন, ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত খোলা রয়েছে। আমি বলছি, তারা (ইরান) একটি চুক্তি করতে চায়। আমরা যদি চুক্তি করতে পারি, তা হবে দারুণ।’

তবে ট্রাম্পের এই শান্তিপূর্ণ কথাবার্তার আড়ালে তাঁর প্রশাসন ইরানের প্রতি কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুই দেশের সম্পর্কে উন্নতির পথ এখনো নানা বাধায় ভরা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের নির্বাহী সহসভাপতি ত্রিতা পারসি বলেন, যখন ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছিল, সেই সময় অর্থাৎ গত জুনে তেহরানে যৌথ হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। এ ঘটনা ইরানে কূটনীতির পক্ষে মানুষের অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে।

ত্রিতা বলেন, ‘ইরানে এখন এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কূটনীতির কথা বলে ইরানকে মিথ্যা নিরাপত্তাবোধে আচ্ছন্ন করছে।’

যখন ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছিল, সেই সময় অর্থাৎ গত জুনে তেহরানে যৌথ হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। এটি ইরানে কূটনীতির পক্ষে থাকা মহলের অবস্থান দুর্বল করে দিয়েছে। ইরানে এখন এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কূটনীতির কথা বলে ইরানকে মিথ্যা নিরাপত্তাবোধে আচ্ছন্ন করছে।

‘ইরান চুক্তির জন্য প্রস্তুত’

ইরান এখনো কূটনীতির দরজা পুরোপুরি বন্ধ করেনি। তবে দেশটির নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ফেরার ব্যাপারে তেমন তাড়াহুড়া করছেন না।

গত শনিবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, ‘আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুক্তিসংগত, ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য কোনো প্রস্তাব পাই, তা অবশ্যই বিবেচনা করব।’

তবে সোমবার ইরান মিসরের শারম আল–শেখে গাজা যুদ্ধ নিয়ে আয়োজিত এক সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। দেশটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে না।

ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করার পর থেকে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা স্থগিত হয়ে আছে। ইসরায়েল গত জুনে আগে বেড়ে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। এর কয়েক দিন পরই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানি কর্মকর্তাদের নতুন দফা আলোচনায় বসার কথা ছিল।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার চুক্তি থেকে সরে গিয়েছিল। এবার ওয়াশিংটন বলছে, নতুন কোনো চুক্তিতে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

‘বেহেশত জাহরা’ কবরস্থানের দেয়ালে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ইরানি সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও অন্যান্য ব্যক্তিদের ছবি। দক্ষিণ তেহরান, ইরান, ১১ জুলাই ২০২৫
‘বেহেশত জাহরা’ কবরস্থানের দেয়ালে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ইরানি সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও অন্যান্য ব্যক্তিদের ছবি। দক্ষিণ তেহরান, ইরান, ১১ জুলাই ২০২৫ছবি: রয়টার্স

কিন্তু এ দাবি আগের চুক্তি ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ)–এর সীমার বাইরে চলে যায়। ওই চুক্তিতে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি আন্তর্জাতিক পরিদর্শন ব্যবস্থার অধীনে সীমিত রাখা হয়েছিল।

ইরান নতুন এ দাবিকে তার সার্বভৌম অধিকারের অস্বীকৃতি হিসেবে দেখছে। তেহরান বলছে, পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি ‘ট্রিটি অন দ্য নন-প্রলিফারেশন অব নিউক্লিয়ার উইপনস’ (এনপিটি) কোনো দেশের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিষিদ্ধ করে না।

এই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ইস্যুই এখন আলোচনার মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পারসি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান এখনো চুক্তির জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ট্রাম্প যতই ইতিবাচক কথা বলুন না কেন, তিনি আসলে চান ইরান আত্মসমর্পণ করুক। যত দিন তিনি শূন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের দাবি ধরে রাখবেন, তত দিন কোনো চুক্তি সম্ভব নয়।’

বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত খোলা রয়েছে। আমি বলছি, তারা (ইরান) একটি চুক্তি করতে চায়। আমরা যদি চুক্তি করতে পারি, তা হবে দারুণ
ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট

ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে তেহরানের শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় বহু মানুষ নিহত হন। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেকসই চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় আরও বাড়িয়েছে।

সোমবার নেসেটে দেওয়া ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘যুদ্ধের সময় ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবর্ষণ ছিল ‘বাইবেলে বর্ণিত অলৌকিক ঘটনা’।

এদিকে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান ও এর মিত্র সংগঠনগুলো, যেমন হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়ে এসেছে। এতে ইরান উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের তরফে তেহরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণসহ অন্যান্য বিষয়ে ছাড় দেওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

ইরান যুক্তরাষ্ট্রের নতুন দাবিকে তার সার্বভৌম অধিকারের অস্বীকৃতি হিসেবে দেখছে। তেহরান বলছে, পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি ‘ট্রিটি অন দ্য নন-প্রলিফারেশন অব নিউক্লিয়ার উইপনস’ (এনপিটি) কোনো দেশের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিষিদ্ধ করে না।

ট্রাম্প প্রায়ই দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ‘ধ্বংস হয়ে গেছে’। যদিও এর ক্ষতির মাত্রা এখনো স্পষ্ট নয়। পেন্টাগন বলেছে, এ হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এক থেকে দুই বছর পিছিয়ে গেছে।

কিন্তু জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থা আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি সতর্ক করেছেন, ইরান কয়েক মাসের মধ্যেই আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করতে সক্ষম হতে পারে।

 
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ও পরে স্যাটেলাইটে তোলা ইরানের ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনার দৃশ্য। কোম, ইরান, ২০ জুন ২০২৫ (বাঁয়ের ছবি) ও ২২ জুন ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ও পরে স্যাটেলাইটে তোলা ইরানের ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনার দৃশ্য। কোম, ইরান, ২০ জুন ২০২৫ (বাঁয়ের ছবি) ও ২২ জুন ২০২৫ছবি: রয়টার্স

ইরানকে অপেক্ষায় রাখতে পারেন ট্রাম্প

ইরান জোর দিয়ে বলছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না। অন্যদিকে, সাধারণভাবে মনে করা হয় যে ইসরায়েল ঘোষণা না করলেও তার পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউরেশিয়া গ্রুপের ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক গ্রেগরি ব্রিউ মনে করেন, ইরানের সঙ্গে সংঘাতে ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করেছে ‘সময়’। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ট্রাম্প কূটনীতি নিয়ে আশার কথা শোনাতে পারেন; কিন্তু তিনি সময় নিতে পারেন ও ইরানকে উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষায় রাখতে পারেন।’

ব্রিউ আরও বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা যদি তা পুনর্গঠনের চেষ্টা করে, তবে নতুন করে ইসরায়েলি হামলার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও অন্য নেতৃত্বের সামনে ভালো তেমন বিকল্প নেই।’

অন্যদিকে, জাতিসংঘ সম্প্রতি ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের উদ্যোগে ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দেশ তিনটি বলেছে, ইরান জেসিপিওএর শর্ত ভেঙেছে।

আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুক্তিসংগত, ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য কোনো প্রস্তাব পাই, তা অবশ্যই বিবেচনা করব
আব্বাস আরাগচি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

তেহরান পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালেই একতরফাভাবে ওই চুক্তি থেকে সরে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা আইএইএর মাধ্যমে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পরিদর্শনের বিষয়টি আর প্রাসঙ্গিক নয়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার পর।

আইএইএর ওপর ক্ষোভও প্রকাশ করেছে ইরান। কারণ, সংস্থাটি তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় হওয়া হামলার নিন্দা জানায়নি। তেহরান বলছে, আন্তর্জাতিক আইনে এসব স্থাপনা সুরক্ষিত রাখার নিশ্চয়তা দেওয়া আছে।

ব্রিউ বলেন, ‘ইরানের কোনো ছাড় না পেলে ট্রাম্পের জন্য আলোচনায় ফেরায় তেমন লাভ নেই। আর ইরান এখন দুর্বল হয়ে পড়ায় তারা ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে তেমন হুমকি তৈরি করতে পারছে না। ফলে ট্রাম্পের পক্ষে তেহরানের ওপর চাপ বাড়তে দেওয়াই সুবিধাজনক।’

‘ট্রাম্প হয়তো কয়েক মাস অপেক্ষা করবেন। দেখবেন, অর্থনৈতিক চাপ বাড়লে ইরান নিজেই অনুকূল শর্তে আলোচনায় ফেরে কি না’, বলেন এই বিশ্লেষক।