Image description

পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা এখন চরমে। এই অস্থিরতার মধ্যে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ইরাক। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মঞ্চ থেকে সরাসরি ইরাকের প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এতে প্রশ্ন উঠেছে—ইসরায়েলের লক্ষ্য কী, আর এই বার্তার আসল অর্থ কী?

এই ঘটনা ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন ইরাকের ভেতরে প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর কাছে অস্ত্র থাকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। সামনে নির্বাচনও রয়েছে। তার ওপর সিরিয়া সীমান্ত থেকে আসা হুমকিও অব্যাহত। সব মিলিয়ে ইরাক এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে—বাগদাদ কি ইসরায়েলের যুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে পরিণত হতে যাচ্ছে, নাকি টিকে থাকবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভঙ্গুর কিন্তু কার্যকর এক ভূমিকা নিয়ে?

গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া বক্তৃতায় নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে ইরাকের নাম উল্লেখ করে বলেন, প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে তাদের পরিণতি ভোগ করতে হবে। জবাবে ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ হুসেইন এই হুমকিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে নিন্দা করেন। তিনি বলেন, একজন ইরাকি নাগরিকের ওপর কোনো হামলা হলে, তা পুরো জাতির ওপর হামলার সমান ধরা হবে।

আল-মায়েদিন ইরাককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বতন্ত্র রাজনীতিক আবু মিসাক আল-মাসার নেতানিয়াহুর হুমকিকে ‘অর্থহীন’ বলে উড়িয়ে দেন। তাঁর মতে, নেতানিয়াহু দুর্বল অবস্থায় আছেন। গাজায় কোনো স্পষ্ট বিজয় তিনি আনতে পারেননি, বন্দীদের মুক্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছেন। তাহলে তিনি কোন শক্তিতে এমন অকারণ হুমকি দিচ্ছেন? আল-মাসার বলেন, ইরাকের বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসন চালালে ইসরায়েল নিজেই জড়িয়ে পড়বে ব্যয়বহুল এক বিপদে।

সভরেইন্টি অ্যালায়েন্স পার্টির নেতা আম্মার আল-আজজাওয়ি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সমর্থন না থাকলে নেতানিয়াহু এমন বক্তব্য দেওয়ার সাহসই পেতেন না। তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘে তাঁর বক্তৃতার সময় অর্ধেক হল খালি ছিল। এটি প্রমাণ করে যে, তিনি এখন দুর্বলতম অবস্থায় আছেন। ব্যর্থতা ঢাকতেই তিনি মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরাতে চাইছেন।’

আজজাওয়ি আরও বলেন, ‘ইরাক এখন প্রতিরোধ অক্ষের মূল স্তম্ভ হয়ে উঠেছে।’ এসব গোষ্ঠী ইরাকি সমাজ ও রাজনীতির গভীরে প্রোথিত। ফলে নেতানিয়াহুর হুমকি তাদের দুর্বল করেনি, বরং নির্বাচনী সম্ভাবনা আরও শক্তিশালী করেছে। তাঁর ভাষায়, ‘ইসরায়েল ইরাকের মুখোমুখি নীরব থাকতে পারে না, কিন্তু সংঘাতের পরিণতিও সহ্য করতে পারবে না।’

ইসরায়েল বেপরোয়া বক্তব্য দিলেও বাস্তবে ইরাকের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়াবে—এমন সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। আল মায়েদিন ইরাককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আঈদ আল-হিলালি বলেছেন, ‘বাগদাদ, প্রতিরোধ গোষ্ঠী ও ওয়াশিংটনের মধ্যে হওয়া সমঝোতার কারণে এখনো তুলনামূলক শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে। এ সমঝোতার পেছনে আন্তর্জাতিকভাবে তেল সরবরাহের স্থিতিশীলতা আর ইরাকে বৈশ্বিক বিনিয়োগের নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’

ইরাকের প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে নিরস্ত্র করা বহুদিন ধরেই দেশটির রাজনীতির একটি কেন্দ্রীয় ইস্যু। এদিকে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ অক্ষকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা তীব্রতর হয়েছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদকে ‘ইরান থেকে দূরে’ রাখতে চাপ বাড়িয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইরাকের চারটি প্রতিরোধ গোষ্ঠী—আল-নুজাবা মুভমেন্ট, কাতাইব সাইয়্যেদ আল-শুহাদা, আনসারুল্লাহ আল-আউফিয়া ও কাতাইব ইমাম আলী—কে তাদের কথিত সন্ত্রাসী তালিকায় যুক্ত করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আল-আজজাওয়ি বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকে ইরাকি গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করা ইসরায়েলের ধারাবাহিক লক্ষ্য। যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের মাধ্যমে তারা এই লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করেছে। তবে নিরস্ত্রীকরণের দাবি কেবল প্রচারমূলক কথাবার্তাই বলে তিনি মনে করেন। তাঁর ভাষায়, ‘একটি বা দশটি গোষ্ঠী নিরস্ত্র করলেও বাস্তবতা বদলাবে না। সব ইরাকি ইসরায়েলকে প্রত্যাখ্যান করে এবং প্রয়োজনে তারা নিজেরাই অস্ত্র তুলে নেবে।’ তাঁর মতে, ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অক্ষের কৌশলগত ঘাঁটি ইরাক। ফলে ইরাককে দুর্বল করার চেষ্টা আসলে পুরো প্রতিরোধ অক্ষকে দুর্বল করারই অংশ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক হুসেইন আল-কিনানি আল মায়েদিন ইরাককে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত ইরাকের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘মার্কিন স্বার্থই ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে প্রতিরোধ গোষ্ঠীর হামলা থামানোর যে সমঝোতা হয়েছিল, সেটিই মূল ভূমিকা রেখেছে।’ তিনি আরও বলেন, বহু ইরাকির কাছে নিরস্ত্রীকরণের ধারণাই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো কোনো সেনাবাহিনী নয়, যাদের ট্যাংক বা যুদ্ধবিমান আছে। বরং তারা জাতীয় মর্যাদা রক্ষার ইচ্ছা ও দখলদারদের মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। জোর করে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে—যেমনটি আগেও মার্কিন সেনারা ইরাকের বিভিন্ন শহরে করেছে—তা নতুন করে গৃহযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে।

ইসরায়েলের সরাসরি হুমকি আর দেশীয় বিতর্ক ছাড়াও ইরাককে সিরিয়া থেকেও নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী সিরিয়ার ইরাক সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করছে। এতে সীমান্ত পেরিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনি ইরাকের বিরুদ্ধে নতুন ইসরায়েলি অভিযানের অজুহাতও তৈরি হতে পারে।

এ অবস্থায় বাগদাদ সতর্ক কূটনৈতিক ভঙ্গি বজায় রেখেছে। একদিকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনও ধরে রাখছে। এতে দেশীয় শান্তি বজায় থাকছে, পাশাপাশি বাইরের পদক্ষেপও হিসেব করে নেওয়া যাচ্ছে। আল-কিনানি বলেন, ‘বিশেষ করে, ইরাক-সিরিয়া সীমান্তকে স্থিতিশীল রাখার জন্য একটি সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক ইচ্ছা রয়েছে। এটা এই কারণে নয় যে ওয়াশিংটন হঠাৎ প্রতিরোধ গোষ্ঠীর পক্ষে গেছে। আসল কারণ হলো, ইসরায়েল ইতিমধ্যেই একাধিক ফ্রন্টে চাপে রয়েছে।’

কিনানি আরও বলেন, উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার আল-হাওল শিবির এই দুর্বলতাকেই উন্মোচিত করছে। সেখানে হাজার হাজার সাবেক আইএস যোদ্ধা ও তাদের পরিবার বসবাস করছে। এই শিবির এখনো চরমপন্থী মতাদর্শ ছড়ানোর বড় কেন্দ্র হিসেবে রয়ে গেছে, যা ইরাকের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। শিবিরটি নিয়ন্ত্রণ করছে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) এবং এর বেসামরিক শাখা নর্থ অ্যান্ড ইস্ট সিরিয়া স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসন।

এই ইস্যুতে শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সশস্ত্রবাহিনী শাখা সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) বৈঠকের পর কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল ব্র্যাড কুপার বলেন, সিরিয়ার আল-হাওল শিবিরে আটক ও বাস্তুচ্যুত বিদেশি নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরানো এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপ। তাঁর মতে, এ উদ্যোগ আইএস দমনে কার্যকর হবে এবং তাদের পুনরুত্থান ঠেকাতে সাহায্য করবে।

বাগদাদ এই শিবির ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করলেও বাস্তবে নানা জটিলতা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি সরকারগুলো নিজেদের নাগরিককে ফেরাতে রাজি নয়। এতে রাজনৈতিক ও লজিস্টিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি ইঙ্গিত করছে—ইরাক এখন এমন এক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে নিরাপত্তা হুমকি ঘরোয়া, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক—তিন স্তরেই সক্রিয়।

বর্তমানে ইরাকের অবস্থান নাজুক। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর হুমকি বেপরোয়া হলেও তা সরাসরি সামরিক পদক্ষেপে গড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে না। কারণ, বৈশ্বিক তেলের প্রবাহে ইরাকের গুরুত্ব অনেক। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এক ধরনের ভারসাম্যও টিকে আছে। অন্যদিকে ইরাকে প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, তারা শুধু সমাজের ভেতরেই মিশে নেই, বরং দখলদারিত্ব আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ শক্তি হিসেবেও কাজ করছে।

সিরিয়া সীমান্তও ইরাকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এ ঝুঁকি তারা পুরোপুরি দূর করতে পারবে না। কেবল কূটনীতি আর সতর্ক নিরাপত্তা নীতি দিয়ে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ইরাক একই সঙ্গে দুর্বল ও অপরিহার্য। তাদের স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে ভেতরের শক্তি, প্রতিরোধের গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলের স্বীকৃতির ওপর। বাগদাদ এখন নতুন আঞ্চলিক সংঘাতের ময়দান হবে, নাকি স্থিতিশীলতার কেন্দ্র হয়ে উঠবে—তা শুধু ইরাকের সিদ্ধান্তে নয়, বরং তাদের মিত্র ও প্রতিপক্ষের হিসাব-নিকাশের ওপরও নির্ভর করছে।

লেবাননের সংবাদমাধ্যম আল–মায়েদিন থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান