Image description
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণাকে কখনোই ভালো চোখে দেখেনি ইসরায়েল। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে অঙ্গীকার করেছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বলে কিছু থাকবে না।

গতকাল বৃহস্পতিবার এই তথ্য জানিয়েছে এএফপি।

গত কয়েক মাসে পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।

 চলতি মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ওই সিদ্ধান্তকে আনুষ্ঠানিকতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে ফ্রান্স, কানাডা, মাল্টা, বেলজিয়াম ও ব্রিটেন। আরো কয়েকটি দেশ বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে।

স্বভাবতই, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির উদ্যোগে 'তেলে বেগুনে' জ্বলে উঠেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার প্রশাসনের নেতারা। সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এ ধরনের উদ্যোগের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব থাকবে না

অধিকৃত পশ্চিম তীরে একটি নতুন ও বড় আকারের বসতি স্থাপন প্রকল্পের চুক্তি সইয়ের অনুষ্ঠানে এই অঙ্গীকার করেন বিশ্বজুড়ে নিন্দিত নেতা নেতানিয়াহু।

জেরুসালেমের ঠিক পূর্বে অবস্থিত ইসরায়েলি অবৈধ বসতি মাআলে আদুমিমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের অঙ্গীকার পূরণ করব। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। ওই জায়গাটি আমাদের জন্য নির্ধারিত।'

পশ্চীম তীরে ইসরায়েলি সেনা ১৬টি ফিলিস্তিনি দোকান ভেঙে দেয়। ছবি: এএফপি
পশ্চীম তীরে ইসরায়েলি সেনা ১৬টি ফিলিস্তিনি দোকান ভেঙে দেয়। ছবি: এএফপি

'আমরা আমাদের উত্তরাধিকার, আমাদের ভূখণ্ড ও আমাদের নিরাপত্তাকে সমুন্নত রাখব। আমরা এই নগরীর জনসংখ্যা দ্বিগুণ করব', যোগ করেন নেতানিয়াহু।

নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ওই অনুষ্ঠানটি লাইভে সম্প্রচার করা হয়।

পশ্চিম তীরের ই১ প্রকল্প

অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় অর্ধেক অংশকে পাকাপাকিভাবে নিজ ভূখণ্ডের অংশ করে নিতে চায় ইসরায়েল। দীর্ঘদিন ধরে এটি 'ইসরায়েলিদের উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন' হিসেবে বিবেচিত।

ই১ নামে পরিচিত ১২ বর্গকিলোমিটার (পাঁচ বর্গমাইল) দীর্ঘ ওই জায়গাটিতে অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই চূড়ান্ত করা। তবে এতদিন আন্তর্জাতিক মহলের বিরোধিতার মুখে সেটি আলোর মুখ দেখেনি।

ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের ই১ প্রকল্প। ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের ই১ প্রকল্প। ছবি: সংগৃহীত

ক্ষুদ্র ভূখণ্ডটির অবস্থান জেরুসালেম ও ইসরায়েলি অবৈধ বসতি (সেটেলমেন্ট) মালে আদুমিমের মাঝে। এটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী অংশের খুব কাছাকাছি। 

গত মাসে ওই 'অত্যন্ত সংবেদনশীল' ভূখণ্ডে তিন হাজার ৩০০ বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনায় সমর্থন জানান ইসরায়েলি কট্টর ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মৎরিচ। 

এর বাস্তবায়ন হলে পশ্চিম তীর কার্যত দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং একটি ভাগ স্থায়ীভাবে ইসরায়েলের অংশ হবে।

 নতুন মাত্রায় অবৈধ অধিগ্রহণ

১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর অবৈধভাবে অধিগ্রহণ করে রেখেছে ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এই অধিগ্রহণ পুরোপুরি অবৈধ।

তা সত্ত্বেও, সেখানে ধারাবাহিকভাবে বসতি স্থাপন ও সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে ইসরায়েল। যার ফলে, ক্রমশ কমে আসছে ফিলিস্তিনিদের বসবাসের জায়গা। 

পশ্চিম তীরে এক ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েলি সেনা। ছবি: এএফপি
পশ্চিম তীরে এক ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েলি সেনা। ছবি: এএফপি

তবে ওই তথাকথিত ই১ প্রকল্প অধিগ্রহণকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে—অধিগ্রহণ রূপান্তরিত হবে 'দখল' বা 'অ্যানেক্সেশনে', যেমনটি ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ অধিগ্রহণের পর দখল করেছে রাশিয়া।

২২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে (ইউএনজিএ) ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পাশাপাশি আরও কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে।

যুক্তরাজ্য বলেছে, সম্মেলনের আগে গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে সম্মতি দিতে না পারলে যুদ্ধ বন্ধের বিকল্প পন্থা হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে তারা।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে 'কবর' দিতে চায় ইসরায়েল

অপরদিকে, ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থি মন্ত্রী ও নেতারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই পশ্চিম তীরের ওই ভূখণ্ড 'দখল' করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

অর্থমন্ত্রী স্মৎরিচ বলেন, 'এই উদ্যোগ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চিন্তাধারাকে কবর দেবে।'

এরপর গত বুধবার তিনি আরও বলেন, 'আমাদের (ইসরায়েলের) ক্ষুদ্র ভূখণ্ডকে দ্বিভাজিত করে এর ঠিক কেন্দ্রে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাকে চিরতরে বানচাল' করার জন্য পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ ইসরায়েলি ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। 

ই১ প্রকল্পের মানচিত্র হাতে অর্থমন্ত্রী স্মৎরিচ। ছবি: সরকারি গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত
ই১ প্রকল্পের মানচিত্র হাতে অর্থমন্ত্রী স্মৎরিচ। ছবি: সরকারি গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত

তার এই ঘোষণায় আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়।

জাতিসংঘ প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, 'এভাবে বসতি স্থাপন করা হলে কার্যত পশ্চিম তীর দুই ভাগে বিভক্ত হবে এবং এটা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য "অস্তিত্ব সংকট" সৃষ্টি করবে।'

ইসরায়েলি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পিস নাউ পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন কার্যক্রমের ওপর নজর রাখে। সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ই১ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হতে পারে এবং এক বছরের মাথায় সেখানে অবকাঠামো তৈর হয়ে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

সংস্থাটি জানায়, ই১ পরিকল্পনা 'দুই-রাষ্ট্র সমাধানে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করবে এবং এটি ইসরায়েলের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের প্রতি হুমকি।' 

ইতোমধ্যে পূর্ব জেরুসালেম 'দখল' করে নিজ ভূখণ্ডের অংশ করে নিয়েছে ইসরায়েল।

পশ্চিম তীরে প্রায় ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি ও পাঁচ লাখ ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারী বসবাস করেন।

গাজার বেশিরভাগ অংশ ইসরায়েলের দখলে

২৩ মাস গাজায় নিরবচ্ছিন্নভাবে গণহত্যামূলক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস হামলা চালায়। এতে এক হাজার ২০০ ব্যক্তি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হন। সেদিনই প্রতিশোধ নিতে আগ্রাসন শুরু করে নেতানিয়াহুর সেনারা।

এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনার হাতে ৬৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার বেশিরভাগ অংশ এখন কার্যত ইসরায়েলের দখলে। গাজা সিটি থেকেও ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি সেনা।

গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার বিশ্ব সম্প্রদায়কে নাড়া দিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ছবি: এএফপি
গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার বিশ্ব সম্প্রদায়কে নাড়া দিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ছবি: এএফপি

গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণ সুদানসহ বিভিন্ন দেশে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা চলছে।

এদিকে পশ্চিম তীরেও ফিলিস্তিনিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।

সব মিলিয়ে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন পৃথক রাষ্ট্র গঠন, অর্থাৎ, দুই রাষ্ট্র সমাধানের মাধ্যমে ঐ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা এখন আর নেই বললেই চলছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো নাটকীয় পদক্ষেপ না নিলে বা ইসরায়েলি আগ্রাসনে রাশ টেনে ধরতে না পারলে আসলেও হয়তো নেতানিয়াহুর অঙ্গীকার অনুযায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মুছেই যাবে।