
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এখন বেশ বড় ভূমিকায় বাংলাদেশ। দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় আওয়ামী লীগের অপশাসন অবসানের পর বদলে গেছে সব চিত্র। ভারতের কাছে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে বের হওয়ার পর খুলে গেছে অর্থনীতির অসীম দুয়ারও। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে ভারতকে হটিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ, চীনের পর যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক বন্ধু। তৃতীয় অবস্থানে নেমে এসেছে ১৫ বছর দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখা ভারত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থছরের মে মাসে দেশের রপ্তানি আয় ৪৭৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারে পৌঁছেছে। এ সময়ে আমদানি হয়েছে ৭৫৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। এ মাসটিতে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ২৭৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের।
বিবিএসের হিসাবে, মে মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানিতে ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ শেয়ার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে চীন। এ সময় দেশটির সঙ্গে ২৮ হাজার ২২৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়েছে বাংলাদেশের। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপির সাময়িক হিসাবে প্রতি ডলার ১২০ টাকা ২৯ পয়সা হিসাবে ধরা হয়েছে। সে হিসেবে দেশটির সঙ্গে শুধু মে মাসে লেনদেন হয়েছে ২৩৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের। চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের আমদানি হয়েছে ২২৭ কোটি ডলারের পণ্য। দেশটিতে বাংলাদেশের সাত কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ বাণিজ্য শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে অবশ্য বাংলাদেশের রপ্তানি বেশি। মে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি হয়েছে ১১৯ কোটি ১১ লাখ ডলারের। এ সময় দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি হয়েছে ৯২ কোটি ৭১ লাখ ডলারের। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাণিজ্য হয়েছে ২৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানির চেয়ে আমদানিই বেশি। মে মাসে দেশটির সঙ্গে মোট বাণিজ্য হয়েছে ১০৭ কোটি ডলারের। এ সময়ে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ৯২ কোটি ডলারের এবং ভারতে রপ্তানি করেছে মাত্র ১৫ কোটি ডলারের পণ্য।
শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বেশি। বাকি দুই দেশের কাছ থেকে আমদানি হয় বেশি। বিশ্বের রাজনৈতিক ও শুল্কযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের আরো সুযোগ বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতের কাছে রপ্তানি করে দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য। একই সময় দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানি ১১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অর্থাৎ, প্রতিবেশী এ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এটি যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক ঘাটতি। ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে কটন, সুতা, কেমিক্যাল, যন্ত্রপাতি, খাদ্যশস্য, গাড়ি, বিদ্যুৎ- যা বাংলাদেশের উৎপাদনশীল শিল্পের জন্য অপরিহার্য।
তবে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরত্ব বেড়েছে। ভারত বাংলাদেশের মতো এলডিসি দেশগুলোকে ডিউটি ফ্রি ট্যারিফ রেফারেন্স (ডিইটিপি) সুবিধা দিয়েছে। কাগজে-কলমে প্রায় সব পণ্য ডিউটি ফ্রি। কিন্তু নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার (এনটিবি), যেমন- স্ট্যান্ডার্ড ও টেস্টিং জটিলতা, কোটা/লাইসেন্সিং সীমাবদ্ধতা (বিশেষত কৃষি ও প্রসেসড ফুডে), সীমান্তে কাস্টমস দেরি, লজিস্টিক ঘাটতির (বেনাপোল-পেট্রাপোল জট) মতো বিষয়গুলো বাংলাদেশি পণ্যকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া ভারতীয় বাজারে ভোক্তাদের জন্য বাংলাদেশি পণ্য ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ তৈরি করতে পারেনি। অন্যদিকে ভারতীয় এফএমসিজি, গাড়ি, টেক্সটাইল বাংলাদেশে আধিপত্য করেছে।
ভারত ও চীনে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির ফলে সেখান থেকে পণ্য আমদানি অনেক ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা আমেরিকান ক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান ক্রয়াদেশও পাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের দ্বিতীয় অবস্থানে আসাটা সুখবরই। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় স্থবিরতা চলছে। এ জন্য তারা তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ আমার দেশকে বলেন, গত এক বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, সেটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে যাচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশ, রাজনৈতিক দল ও জনগণেরও একটি অংশের মধ্যে আগের রেজিমের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক, সেটি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। সেটিকে কেন্দ্র করে যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক- যার মধ্যে সরকারের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন আলোচনা থাকে, বিশেষ করে বাণিজ্য আলোচনাও থাকে, সেটি এখন স্থবিরতার মধ্যেই আছে। এসব সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতের ভিসা রেস্ট্রিকশন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ভারত। মাশরুর রিয়াজ বলেন, ভারতও অনেক বিধিনিষেধ দিয়েছে। দিল্লি বিমানবন্দর ব্যবহার করে অন্য দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হতো, সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ সবকিছুই ব্যবসার সহায়ক প্রক্রিয়াগুলোতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন। ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে এই পাল্টা শুল্ক। প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান এক্ষেত্রে সুবিধাজনক।
বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি তিন লাখ টন গম আমদানি করবে সরকার। প্রতি টনে ২০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার বেশি দিয়ে হলেও এ গম যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হবে। তবে এ দফায় তিন লাখ টনের এমওইউ হচ্ছে না, হচ্ছে দুই লাখ ২০ টনের। প্রতি লটে বা কনসাইনমেন্টে এক লাখ ১০ হাজার টন করে গম আসবে।
গত জুন মাসে শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। আগের অর্থবছরে রপ্তানি ছিল ৭৬৮ কোটি ডলারের। এর বিপরীতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ দেশটি থেকে আমদানি করেছে ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য। অথচ আগের অর্থবছরে আমদানি করেছিল ২৬২ কোটি ডলারের। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একক পণ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় স্ক্র্যাপ লোহা বা লোহার টুকরো। আর দেশটিতে একক পণ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা হয় তৈরি পোশাক।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, গমের পাশাপাশি উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, ভোজ্যতেল, তুলা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ইত্যাদি আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনবে বাংলাদেশ, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ আগে থেকেই ১৯০টি পণ্যের শুল্কহার শূন্য রেখেছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট করার সময় আরো ১০০ পণ্যকে এ তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। যদিও এ সুবিধা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্য দেশও পাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসাটা ইতিবাচক জানিয়ে পিইবির চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, এ সময় যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসাটাও আশার আলো। কারণ, বাংলাদেশে তার যে মার্কেট আছে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্ভব। বিশেষ করে দেশটিতে বাণিজ্যের ঝুঁকি কমানো, পণ্যের বাজার উন্মোচন করা। এটি খুব ভালো খবর যে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশ বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে।
শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এখন কিছু অপ্রচলিত রপ্তানি আদেশ পাচ্ছে। এ ক্রয়াদেশগুলো এর আগে ভারত থেকে আমদানি করা হতো। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে- হার্ডওয়্যার আইটেম, নির্মাণসামগ্রী, পিভিসি পাইপ ও পিপি বোনা ব্যাগ, দেশের বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য পোশাক।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ট্যারিফ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য আরো বাড়বে। এর বিপরীতে স্থলবন্দর বন্ধ থাকায় ভারতে আমাদের রপ্তানি আরো কমতে পারে। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য সম্পর্ক অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্যারিফ ইস্যুতে আমাদের ব্যবসা আরো বাড়বে। অন্যদিকে দেশটির সঙ্গে আমাদের প্রতিশ্রুতি আছে, সে জন্য আমদানিও বাড়বে। সরকার এলএনজি আমদানি করছে, আমরা কটন আমদানি করব, গমও আসবে। এটি আরো বাড়বে।’
মাহমুদ হাসান খান আরো বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ভারতের যে বাণিজ্য সম্পর্ক, দেশটির সঙ্গে আমাদের আমদানি সম্পর্ক বাড়তে পারে; কিন্তু রপ্তানি আরো কমতে পারে। কারণ, আমরা স্থলবন্দর ব্যবহার করতে পারছি না। তবে এটি চূড়ান্ত বিষয় নয়, বরং ওঠানামা করবে।’