
গত কয়েক বছর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে উথালপাথাল শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা একের পর এক সরকারকে গদিছাড়া করছে জনগণ; আরও নির্দিষ্ট করে বললে জেনারেশন জেড বা তরুণ প্রজন্ম। এর ধারা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে; এরপর বাংলাদেশ, সবশেষ যোগ হয়েছে নেপাল।
মজার বিষয় হলো- শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে সরকারের পতন হয়েছিল জুলাই মাসে, বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন হয় আগস্ট মাসে, আর নেপালে ওলি সরকার পতন হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে। এটি কি কেবলই কাকতালীয়? কী বলা যায় একে- ডমিনো ইফেক্ট, চেইন রিঅ্যাকশন নাকি ক্যালেন্ডারিকাল প্যাটার্ন? যদি এমন কিছুই হয়, তাহলে এর পরবর্তী শিকার কে? সেটি কি অক্টোবর মাসে ঘটবে? অক্টোবরে ঘটলে কোন বছরে? একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন!
এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই বলে দেবে। তার আগে জেনে নেওয়া যাক কীভাবে আগের আন্দোলনগুলো দক্ষিণ এশীয় নেতাদের ক্ষমতাচ্যুতির দিকে নিয়ে গেলো?
শ্রীলঙ্কা
২০২২ সালের মাঝামাঝি নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে শ্রীলঙ্কা। ওই বছরের মার্চ থেকে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দেয়। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং শুরু হয়, আর মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়।
তখন ক্ষমতায় ছিলেন রাজাপাকসে পরিবারের দুই প্রভাবশালী ভাই – প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসা গোতাবায়া নজিরবিহীনভাবে নির্বাহী ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন।
ফলে, অর্থনীতির চরম দুর্দশার জন্য জনগণের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে সরকারের ওপর। দেশটি পর্যটননির্ভর ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি ও ২০১৯ সালের ইস্টার বোমা হামলার পর এই শিল্প একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হওয়ার পথে ছিল এবং ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ খেলাপি হয়ে গিয়েছিল।
এ অবস্থায় জাতিগত ও শ্রেণিগত সীমারেখা ভেদ করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। রাজধানী কলম্বোতে প্রেসিডেন্ট হাউজের সামনে বিশাল আন্দোলন ক্যাম্প বসানো হয়। বহু সমাজতান্ত্রিক ছাত্রসংগঠন এতে অংশ নিয়েছিল।
‘গোতা গো হোম’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বিক্ষোভস্থল। এরপরও ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জরুরি অবস্থা জারি করেন, কারফিউ দেন, সেনা মোতায়েন করেন। নিরাপত্তাবাহিনী আন্দোলনকারীদের মারধর ও গ্রেফতার করে।
মে মাসে সহিংসতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কলম্বোতে সরকারপন্থিদের হামলায় প্রায় ২০০ জন আহত হন। পুলিশ জলকামান ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে। অন্যত্র দুই সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। সেসময় মাহিন্দা রাজাপাকসের বাড়ি এবং আরও কয়েকজন সরকারপন্থি নেতার বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
একপর্যায়ে গোতাবায়া ছাড়া পুরো মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। সংসদীয় জোট ভেঙে সংখ্যালঘুতে পরিণত হলে তিনি আবার জরুরি অবস্থা জারি করেন। জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
গোতাবায়া ষষ্ঠবারের মতো রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। তাকে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীলতার প্রতীক ধরা হলেও অস্থিরতা কাটেনি।
৯ জুলাই আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্ট হাউজ দখল করে। তারা প্রাসাদের পুকুরে সাঁতার কাটে, গোতাবায়ার জিনিসপত্র তছনছ করে, এমনকি তার বাথরুমও ব্যবহার করে। গোতাবায়া তখন পালিয়ে গিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেও আগুন দেয়।
কয়েকদিন পর গোতাবায়া মালদ্বীপ হয়ে সিঙ্গাপুরে পালান এবং পদত্যাগ করেন। বিক্রমাসিংহে প্রথমে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন, পরে নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন রূপ নিয়েছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনে/ ফাইল ছবি
বাংলাদেশ
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিতর্কিত নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো জয়ী হন তিনি। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তার দীর্ঘদিনের শাসন ভেঙে পড়ে। শুরুটা ছিল ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়দের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা ২০১৮ সালে বাতিল করা হলেও সুপ্রিম কোর্ট তা পুনর্বহাল করে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন থামাতে কঠোর দমনপীড়ন চালায় তৎকালীন প্রশাসন। সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান অন্তত ১ হাজার ৪০০ মানুষ। কিন্তু তাতে আন্দোলন থেমে না গিয়ে আরও বড় আকার নেয় এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনকারীদের মূল দাবি হয়ে ওঠে একটাই – হাসিনার পদত্যাগ।
তবে সরকার দমননীতি আরও বাড়ায়। ৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে এক বৈঠকে টানটান পরিস্থিতি তৈরি হয়।
প্রথমে হাসিনা দৃঢ় অবস্থান নেন এবং সেনাবাহিনীকে আন্দোলনকারীদের সরাসরি দমনের নির্দেশ দেন বলে খবর মেলে। কিন্তু সেনাবাহিনী তাতে অস্বীকৃতি জানায়। ৫ আগস্ট সকালে হাসিনাকে জানানো হয়, নিরাপত্তা বাহিনী আর ছাত্রজনতাকে ঠেকাতে পারছে না। তবু অনড় ছিলেন হাসিনা। বোন শেখ রেহানাও তাকে পদত্যাগে রাজি করাতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় রাজি করান।
সেদিনই হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে পালিয়ে যান। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তার পদত্যাগ নিশ্চিত করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। পরদিন সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন।
হাসিনা এখনো ভারতেই অবস্থান করছেন। তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে বিচার করার জোরালো দাবি রয়েছে।
নেপালে বিক্ষোভকারীদের দখলে পার্লামেন্ট ভবন/ ছবি: কাঠমান্ডু পোস্ট
নেপাল
২০২৪ সালের জুলাইয়ে কে পি শর্মা ওলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফের ক্ষমতায় আসেন। তবে তার সরকার শুরু থেকেই অস্থিরতায় ভুগছিল। চূড়ান্ত সংকট আসে ২০২৫ সালের আগস্টের শেষে, যখন সরকার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ দুই ডজনের বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করে।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তরুণ প্রজন্ম। দুর্নীতি, বৈষম্য ও কর্মসংস্থানের অভাবে তারা আগেই অসন্তুষ্ট ছিল। এবারের নিষেধাজ্ঞা ছিল শেষ ধাক্কা। গত ৮ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার মানুষ কাঠমান্ডুসহ সারা দেশে রাস্তায় নেমে আসে। অনেকেই স্কুলের পোশাক পরে বই হাতে বের হয়, ফলে আন্দোলনকে ‘জেন জি বিদ্রোহ’ নাম দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের মতো নেপালেও নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর দমন অভিযান চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাসের পাশাপাশি তাজা গুলিও চালায়। এতে অন্তত ১৯ জন নিহত ও কয়েকশ মানুষ আহত হন।
সংকট নিরসনে সরকার দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তবু বিক্ষোভ থামেনি। ওইদিন সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লাল লেখক পদত্যাগ করেন, পরদিন পদত্যাগ করেন পানি সরবরাহমন্ত্রী প্রদীপ যাদব।
৯ সেপ্টেম্বরও বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে আন্দোলনকারীরা। তারা পার্লামেন্ট ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতার বাড়িতে হামলা হয়। তবে এদিন কারফিউ জারি ও জনসমাবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারে অনীহা দেখায়।
শেষ পর্যন্ত বিরোধী দল ও নিজ জোটের চাপের মুখে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ওলি। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ব্যক্তিগত জেটে করে দুবাইয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।