Image description

১৯৫৯ সালে পাকিস্তান শাসন করতেন একজন জেনারেল, যিনি একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। একইসঙ্গে  নিজেকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করেছিলেন। এটি বৃটিশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ- যার কাঠামো এবং শ্রেণিবিন্যাস বেশ কয়েকটি ঔপনিবেশিক-পরবর্তী দেশ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তিনি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

বেশ কয়েকটি প্রতিকৃতিতে তাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রমাণ মেলে। কোনো ছবিতে দেখা গেছে ফিল্ড মার্শাল খান প্রেসিডেন্ট জনসনের গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কোনোটাতে দেখা যায় প্রেসিডেন্ট জনসন করাচির রাস্তায় একজন উটের গাড়ি চালকের কাছে যাচ্ছেন এবং জিজ্ঞাসা করছেন যে তিনি কি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চান। খান জনসনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব নিয়ে  একটি বই লিখেছিলেন এবং এর নাম দিয়েছিলেন "ফ্রেন্ডস, নট মাস্টার্স"।এর উর্দু অনুবাদে আরও কাব্যিক এবং আরও স্বতঃপ্রণোদিত শিরোনাম রয়েছে: 'জিস রিজক সে আতি হো পারওয়াজ মে কোটাহি।' দার্শনিক ও কবি  মুহাম্মদ ইকবালের আত্মিক ও নৈতিক সংগ্রাম সম্পর্কে লেখা একটি কবিতা থেকে এই লাইনটি ধার করা। যেখানে গর্বের সঙ্গে বলা আছে , আমেরিকা আমাদের খাওয়াতে পারে কিন্তু আমাদের শীর্ষে আরোহণ থেকে বিরত রাখতে পারে না।

পাকিস্তানকে খাওয়ানোর কোনও দরকার ছিল না আমেরিকার । কারণ এটি ছিল একটি কৃষিপ্রধান দেশ এবং দেশের  জমি ছিল অত্যন্ত উর্বর । আমেরিকান শস্যের চেয়েও বেশি, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের আমেরিকান পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন ছিল যাতে তিনি দেশের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন এবং তার মাতৃপ্রতিষ্ঠান, সশস্ত্র বাহিনীকে দেখাতে পারেন যে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

লিন্ডন জনসন একজন সামরিক স্বৈরশাসকের সাথে বন্ধুত্ব ছাড়া আর কী চেয়েছিলেন? একটি শীতল যুদ্ধে  ভূ-কৌশলগত আক্রমণ যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর গোয়েন্দা বিমান হানার জন্য পাকিস্তানের উত্তরে একটি বিমানঘাঁটি ব্যবহার করার অনুমতি দেবে ।

পাকিস্তানে এখন  দ্বিতীয় ফিল্ড মার্শাল এসেছেন । চলতি বছরের মে মাসে ভারতের সাথে একটি সংক্ষিপ্ত এবং বিপজ্জনক সংঘর্ষের পরপরই, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নেতৃত্বদানকারী জেনারেল আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়। তিনিই প্রথম পাকিস্তানি সেনাপ্রধান, যিনি কোনও অভ্যুত্থান না করেই হোয়াইট হাউসে এক আনুষ্ঠানিক মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন যে তিনি মুনিরের  সাথে দেখা করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছেন। পাকিস্তান ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে যা  অত্যন্ত প্রত্যাশিত।

পাকিস্তানে গণতন্ত্রে আছে একটি সংসদ, একটি প্রধানমন্ত্রী, বিচার বিভাগ, একটি সরগরম  সংবাদমাধ্যম।  দুই বছর আগে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানকে কারাগারে পাঠানো হয়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ট্রাম্প বেসামরিক ব্যক্তিত্বদের সাথে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের প্রতি আমেরিকার সবসময়ই একটা নরম অবস্থান ছিল কারণ তারা তাদের গোপন  কৌশলগত পরিকল্পনাকে ওয়ান উইন্ডো অপারেশন হিসেবে দেখে।১৯৮০-এর দশক জুড়ে, জেনারেল জিয়া উল হকের নৃশংস সামরিক একনায়কতন্ত্রকে  আমেরিকা  সমর্থন করেছিল।  কারণ তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের পরাজিত করতে ওয়াশিংটনকে সহায়তা করেছিলেন।  

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ যখন একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেন, তখন আন্তর্জাতিক নজর পড়ে তাঁর ওপর। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকা আক্রমণের পর, আফগানিস্তান আক্রমণের জন্য যখন বুশ প্রশাসনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছিল, তখন তারা জেনারেল মোশাররফের ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে ।  আমেরিকা-পাকিস্তান সখ্যতা নতুন মাত্রা পায়। জেনারেল মুশাররফ দাবি করেছেন যে একজন ঊর্ধ্বতন আমেরিকান কর্মকর্তা হুমকি দিয়েছিলেন যে পাকিস্তান যদি তাদের দাবি মেনে না নেয় তাহলে তারা বোমা মেরে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেবে । একজন জেনারেলের কী বা করার ছিল ? তিনি পূর্ণ সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং আফগানিস্তানে তাদের কথিত তালেবান ভাইদের উপর বোমা হামলা চালানোর জন্য আমেরিকানদের পাকিস্তানের বিমান ঘাঁটি ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়েছিলেন।

এরপর থেকে সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে থাকে। জেনারেল মোশাররফ ওয়াশিংটনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে  তালেবান নেতাদের, এমনকি পাকিস্তানে তাদের রাষ্ট্রদূতকেও আমেরিকানদের হাতে তুলে দেন। তাদের মুখোশ পরিয়ে, মুখ বন্ধ করে, হাতকড়া পরিয়ে   গুয়ান্তানামো বে-তে বিমানে করে পাঠিয়ে দেয়া হয়।  অনেক ক্ষেত্রেই গ্রেফতারের সংখ্যা মেলাতে নিরীহ পাকিস্তানি নাগরিকদের ওয়াশিংটনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বেসামরিক সরকারের আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে । তার প্রথম মেয়াদে, প্রেসিডেন্ট  ট্রাম্প পাকিস্তানের উপর খুশি ছিলেন না এবং দেশটিকে প্রতারক হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কারণ আফগানিস্তানে ওয়াশিংটন যা চেয়েছিল তা পূরণ করতে ইসলামাবাদ ব্যর্থ হয়েছিল ।দ্বিতীয় মেয়াদে, আমেরিকা এবং পাকিস্তানের মধ্যে সেই পুরনো প্রেম পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যা অতীতে তাদের একত্রিত করেছিল: "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা"।

গত বছর, পাকিস্তান সেনাবাহিনী একজন আফগান নাগরিককে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রের  হাতে তুলে দেয়, যিনি কাবুল বিমানবন্দরে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে অভিযুক্ত হয়েছেন। এই হামলায় ২০০ জনেরও বেশি আফগান এবং প্রায় এক ডজন আমেরিকান নিহত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রথম রাষ্ট্রীয় ভাষণে পাকিস্তানকে এজন্য ধন্যবাদ জানান। ডনাল্ড ট্রাম্প প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নন যিনি পাকিস্তানের এই শক্তিশালী সেনাবাহিনী দেখে মনে করেন যে আমি তাদের কাজে লাগাতে পারি। ফিল্ড মার্শাল আসিম  মুনিরও  প্রথম পাকিস্তানি জেনারেল নন যিনি বিশ্বাস করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে  কিছুটা প্রভুর মতো, কিছুটা বন্ধুর মতো এই সম্পর্ক তাকে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করবে ।

মুনিরের সেনাবাহিনী দেশকে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলেছে।  ক্ষমতাসীন দলকে বেছে নেবার অধিকার তাদের আছে , কে  বিরোধী আসনে বসবে তা তারা ঠিক করে দিচ্ছে । তারা ঠিক করে দিচ্ছে আদালত কী করবে , এমনকি ভোটও  চুরি করার অধিকার তাদের আছে। তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি  বিস্তৃত: রিয়েল এস্টেট থেকে সার শিল্প পর্যন্ত। কিন্তু পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদার সৈনিক হিসেবে সত্যিই দক্ষতা রয়েছে। ভারতের সাথে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে, তারা তাদের তৎপরতা এবং প্রস্তুতি দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অবাক করে দিয়েছে। আমেরিকান জেনারেলরা সম্ভবত লক্ষ্য করেছেন যে তাদের পুরানো মিত্রর এখনও শিকার ধরার ক্ষমতা রয়েছে।

তবুও পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ভারতের বিরুদ্ধে বিজয় উদযাপন করছে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে ফিল্ড মার্শাল মুনির মধ্যাহ্নভোজের আনন্দে মেতে উঠেছেন , তখন দেশে তাদের জনপ্রিয়তা সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখা, ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস, তাদের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলোতে  ‘আসসালামুল আলাইকুম’ লিখলেই রাজনৈতিক বিরোধীদের কাছ থেকে  অপমানজনক মন্তব্য ভেসে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেশে সেনার জনপ্রিয়তাকে মোটেই বাড়ায় না। কৌশলগত জোটের মুখোশ এবং পাকিস্তানের  বিশাল তেলের মজু  অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে সবকিছুই আজ পরিষ্কার। কারণ দেশের নাগরিক  এই প্রেমের আখ্যান  আগেও দেখেছে । এর শেষ কখনোই মধুর  হয় না।

আফগানিস্তানের মাটিতে অসংখ্য আফগানের মৃত্যু ঘটে আমেরিকান বিমানের হামলার কারণে। সন্ত্রাসবিরোধী মার্কিন যুদ্ধে পাক সেনাবাহিনীর সহযোগিতার দুই দশকে ৭০,০০০ এরও বেশি পাকিস্তানি নিহত হয়েছে। পরিবর্তে প্রতি কয়েক মাস অন্তর, পাকিস্তান তার অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বোর্ডরুমে ফিরে এসেছে। পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে, আমেরিকান আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এক ধরণের ক্ষোভ রয়েছে যা তাদের নিজস্ব শাসকদের প্রতি অসন্তোষকে বাড়িয়ে তুলেছে। পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক কর্মীকে  একবার বলতে শোনা গেছে যে, যখনই তাদের দল ক্ষমতায় থাকে এবং তাদের কিছু করার প্রয়োজন হয়, তখন তাদের কেবল একটি আমেরিকান পতাকা, একটি দেশলাই বাক্স এবং একটি ক্যামেরার প্রয়োজন হয়। ওই কর্মীর কথায় , 'যদি আপনি আমাদের দাবি মেনে না নেন, তাহলে আমরা এই দেশলাই কাঠিটি আমেরিকান পতাকার সাথে নিয়ে একটি ছবি তুলব, তারপর দেখা যাবে আমেরিকা আসলে আপনার সম্পর্কে কী ভাবে। 'বন্ধু? প্রভু? নাকি সেই দ্বিমুখী পুরনো মিত্র যে এখনও শিকার ধরতে  পারে?