Image description

বিশ্ববাসীকে বোকা বানানোর চেষ্টায় ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) দাবি করছে গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই। এ নিয়ে যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস শুধুই প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু আইডিএফের এমন কোনো প্রমাণ নেই বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। তাদের বিশ্লেষণে উল্টো গাজায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছে তা শক্তভাবে ফুটে উঠেছে। এ খবর দিয়েছে ইসরাইলের প্রভাবশালী পত্রিকা অনলাইন দ্য হারেৎজ। এতে বলা হয়, আইডিএফের দাবি, গাজায় কোনো ক্ষুধা নেই। হামাস ‘গাজা উপত্যকায় ক্ষুধার কাহিনি জোরদার করার সমন্বিত প্রচেষ্টা’ চালাচ্ছে। আইডিএফের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালিত এক গভীর তদন্তে দেখা গেছে, হামাস একটি সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত প্রচারণা চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে ইসরাইলকে বদনাম করার এবং রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ।

বিবৃতিতে প্রথমেই সেনাবাহিনী দাবি করে, জুলাই মাসে ক্ষুধাজনিত মৃত্যুর রিপোর্টে সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। এটা করা হয় ইসরাইল-হামাস আলোচনার সময়ে। আইডিএফ-এর মতে, মৃত্যুর এই সংখ্যা বৃদ্ধি বাস্তব নয়, ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
তবে ক্ষুধা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকেই সতর্ক করে আসছেন, ইসরাইলের ‘ক্ষুধানীতি’ শুরু হওয়ার (২ মার্চ) পর গাজায় অপুষ্টি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাবে। ওইদিন থেকে ইসরাইল ৭৮ দিন ধরে সব সীমান্ত বন্ধ করে খাদ্য প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। মে মাসের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক চাপে দুটি পথে খাদ্য সরবরাহ সীমিত আকারে শুরু হয়। তা বিতরণ করা হয়, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ), জাতিসংঘ ও অন্য ত্রাণ সংস্থার মাধ্যমে। তবু আইডিএফ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে, যাতে এসব সংস্থা পর্যাপ্ত খাবার পৌঁছে দিতে না পারে। গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনও কার্যকরভাবে ২০ লাখ বাসিন্দার খাদ্য জোগাতে ব্যর্থ হয়।

মার্চ থেকে গাজায় কাজ করছে এমন সব ত্রাণ সংস্থা দুর্ভিক্ষের ক্রমবর্ধমান সংকটের কথা জানিয়ে আসছে। শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টির হার ২ শতাংশ থেকে প্রায় পাঁচ মাসে ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। আর বাজারে খাদ্যের দাম আকাশছোঁয়া। ২০ জুলাই হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর বড়সড় সংখ্যা প্রকাশ করে। এর আগে ৮৬ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়।  এরপর আরও ১৫০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আইডিএফ দাবি করে, মৃত্যুর এই সংখ্যা হঠাৎ করে বৃদ্ধিই মন্ত্রণালয়ের অবিশ্বস্ততার প্রমাণ। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবরোধ ও খাদ্য সংকট শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর এ ধরনের মৃত্যুর হার বাড়বে, এটি পূর্বাভাসমতোই ঘটেছে। আইডিএফ আরও অভিযোগ করে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মৃতদের নাম প্রকাশ করেনি। তবে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বন্দুক বা বোমায় নিহত না হলে কারও নামই মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেনি।

আইডিএফের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, গাজার যেসব শিশুর কেস জনসমক্ষে এসেছে তাদের আসলে আগে থেকেই রোগ ছিল। আর তাদের এমন অবস্থা পুষ্টির অভাবে নয়, সেই রোগের কারণেই খারাপ হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ৪ বছরের আবদুল্লাহ হানু মুহাম্মদ আবু জরকার কথা বলা হয়। তার জেনেটিক রোগে ভিটামিন-খনিজ ঘাটতি, হাড় ক্ষয় এবং হাড় পাতলা হয়ে যায়। যুদ্ধের আগে সে ইসরাইলে চিকিৎসা নিচ্ছিল। আরেকটি উদাহরণ- ২৭ বছরের করম খালেদ মুস্তাফা আল-জামাল। তিনি জন্ম থেকে মাংসপেশির দুর্বলতা ও আংশিক পক্ষাঘাতে ভুগছিলেন। আইডিএফ অভিযোগ করে, হামাস এই করুণ ছবিগুলো ‘মিথ্যা প্রচারণায়’ ব্যবহার করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এটা স্বাভাবিক যে আগে থেকেই অসুস্থ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা প্রথমে ক্ষুধার শিকার হয়। বহু রোগের জন্য বিশেষ খাদ্য প্রয়োজন, যা গাজায় পাওয়া যায় না। অপুষ্টি বিদ্যমান রোগকে আরও মারাত্মক করে তোলে। ইসরাইলের ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক চেয়ার প্রফেসর রনি স্ত্রিয়ের বলেন, যদি আশদোদ আর আশকেলনকে তিন মাস খাদ্য ছাড়া অবরুদ্ধ রাখেন, তবে দেখবেন তিন মাস পর মানুষ মারা যেতে শুরু করবে।

ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস-ইসরাইলের আসিল আবুরাস বলেন, অপুষ্টি শরীর দুর্বল করে। রোগ বাড়ায় এবং দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়- এটাই দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রতিরক্ষা বাহিনী এটি উপেক্ষা করছে মানে তারা সত্য মেনে নিতে চাইছে না। ইসরাইলের সিভিল রাইটস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতিকে সমালোচনা করে বলে, যাদের মৃত্যু অপুষ্টিজনিত, তাদের অনেকেরই আগে রোগ ছিল। এটি সত্য। কিন্তু অপুষ্টি এমনিতেই রোগ, গর্ভাবস্থা, বার্ধক্য ও অক্ষমতাকে প্রাণঘাতী করে তুলতে পারে। তারা আরও বলে, এরা যদি ন্যূনতম খাবারও পেত, বেঁচে যেত। তাদের জীবন কি সুস্থ মানুষের জীবনের চেয়ে কম মূল্যবান?

আইডিএফ-এর খণ্ডিত উদাহরণের বিপরীতে, গাজায় কার্যরত সব মানবিক সংস্থা তাদের দাবি টিকিয়ে রেখেছে হাজারো ফিল্ড রিপোর্ট, শিশুদের বাহুর মাপের পরিসংখ্যান, খাদ্য সরবরাহের হিসাব, হাসপাতাল ও ক্লিনিকের রিপোর্ট, গাজার খাদ্যের দামের সূচক- এসব মিলিয়ে। আসিল আবুরাস বলেন, ক্ষুধা ও অপুষ্টি মাপা হয় বিশ্বস্বীকৃত পদ্ধতিতে- আইপিসি, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও, ইউনিসেফের ডাটার মাধ্যমে। এই সব সংস্থার তথ্য বলছে- গাজার বেশির ভাগ মানুষ তীব্র বা সংকটাপন্ন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে, অনেকেই ক্ষুধার সীমা অতিক্রম করেছে। জুলাই মাসে শিশু মৃত্যুহার ও তীব্র অপুষ্টি বেড়েছে। আসিল আবুরাস আরও বলেন, গাজায় ব্যাপক অপুষ্টির প্রমাণ নেই আইডিএফের এই দাবি আইপিসি, ডব্লিউএইচও, ইউনিসেফ, অক্সফাম ও সেখানে কাজ করা প্রতিটি সংস্থার তথ্যের বিপরীত। প্রফেসর রনি স্ত্রিয়েরের মতে, বাস্তবতা বোঝার একমাত্র উপায় হলো- একটি পেশাদার দলকে গাজায় প্রবেশ করে সরেজমিনে মূল্যায়ন করতে দেয়া। রাজনৈতিক ঝড় আর নৈতিক লজ্জা মোকাবিলায় এর বিকল্প নেই।