
আল জাজিরার ডকুমেন্টারি
ভারত বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিষ্কার করছে, নাগরিকত্ব কেড়ে নিচ্ছে, আটক করছে, সর্বোপরি বাংলাদেশে পুশইন করছে। মুসলমানদের এই দমন-পীড়নের পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী রাজনীতি এবং গণমাধ্যমে মুসলমানদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক প্রচারণা। আল জাজিরায় প্রচারিত এক তথ্যচিত্রে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে, ঠিক কী কারণে ভারতের মুসলমানরা নির্যাতন এবং দেশ থেকে বহিষ্কারের শিকার হচ্ছেন।
ভারতে মুসলিম বিদ্বেষী রাজনৈতিক বক্তব্য এবং এ বিষয়ে গণমাধ্যমে যেভাবে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে, তাকে খুবই উদ্বেগজনক হিসেবে বর্ণনা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো এই সমস্যার একটি বড় অংশীদার।
ভারতে মুসলমানদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন করা হচ্ছে, বিশেষ করে বাঙ্গালি মুসলমানদের। তাদের শুধু ঘর শুধু থেকেই নয়, দেশ থেকেও বের করে দেওয়া হচ্ছে। এটা খবই উদ্বেগজনক। এর শুরু ছয় বছর আগে। ভারতের নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি হালনাগাদের কাজ শুরুর পর থেকে। তবে ভারতে জন্ম, বড় হওয়া ও নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও সেই তালিকায় অনেকেরই নাম ওঠেনি। এর ফলাফল, প্রতিবেশি বাংলাদেশে গণহারে বিতারণ।
এখন থেকে এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার মুসলামনাদের সাথে অমানবিক আচরণ করছে, বিশেষ করে যারা বাঙালি। তাদেরকে বলা হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী। বেশিরভাগ ভারতীয় গণমাধ্যমে এই সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের জন্য হুমকি হিসেবে বর্ণরা করা হয়। এটা বেজেপির বৃহত্তর রাজনৈতিক লক্ষ্যের একটি; তারা এটা করছে আইনের দোহাই দিয়ে। এজন্য তারা বিতর্কিত নাগরিকপঞ্জীকে ব্যবহার করছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ১০ বছরের বেশি সময়ের শাসনে, ভারতের মুসলমানদের সাথে অভ্যন্তরীণ শত্রুর মতো আচরণ করা হচ্ছে। আসামে কথিত অবৈশ অভিবাসী ধরার অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে বাঙালি মুসলনামদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই অভিযান আসাম ছাড়িয়ে অন্যান্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে ভারতজুড়ে মুসলমানদের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
সংবাদমাধ্যম স্ক্রলের রাজনৈতিক সম্পাদক শোয়েব দানিয়াল আল জাজিরাকে বলেন, কোন বাঙালি যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হন, তাহলে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়, তাকে পুলিশের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণ দিতে হয়। অনেকে সময় পুলিশ তাদের নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়। এ কারণে অনেক ভারতীয় মুলমানকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এজন্য আতঙ্কে মুম্বাই, গুজরাট, উড়িষ্যা থেকে অনেক বাঙালি শ্রমিক পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসছে।
ভারতের গণমাধ্যমগুলো নাগরিকত্ব প্রমাণের এই প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে সংবাদ প্রচার করছে।
ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনের সম্পাদক বৈষ্ণা রয় বলেন, ‘টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সপ্তাহের প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা মুসলমানদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না।’
সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা পরান গুহ ঠাকুরতা বলেন, ‘ভারতের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই হিন্দু। আর সেখানে ১৪ শতাংশ মুসলমান। সরকারের নাগরিকপঞ্জি প্রকল্প তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছে।’
মুসলমানদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে সুবিধা হয়। মুসলমানরা হিন্দুদের জন্য হুমকি, এটা বলে রাজনীতিবিদরা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মগজ ধোলাই করছেন। একটি দেশ যেখানে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন হিন্দু; সেখানে তাদের এই কৌশল দারুণভাবে কাজ করে।
বিজেপির এই রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে দেশটির গণমাধ্যম। দেশটিতে চার শতাধিক সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। এগুলো বেশিরভাগই নির্ভর করে সরকারের বিজ্ঞাপনের ওপর। আর এ কারণে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারকে সমর্থন করতে একে অপরের সাথে পাল্লা দেয় চ্যানেলগুলো। প্রচার করে বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী নীতি: ‘মুসলমানরা হিন্দুদের জন্য হুমকি।’
তবে অভিযোগ প্রমাণ করতে গেলে, তা আর ধোপে টেকে না।
বৈষ্ণুা রয় বলেন, ‘হিন্দুরা অবশ্যই সংখ্যাগুরু। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, শিক্ষায় সবক্ষেত্রে হিন্দুরা এগিয়ে। কাজেই হিন্দুরা হুমকির মুখে এটা একেবারেই ভুল ধারনা।’
শোয়েব দানিয়াল বলেন, ‘যদি ২৪ ঘণ্টা একই জিনিস প্রচার করা হয়, তাহলে কেউ কেউ তো তা অবশ্যই বিশ্বাস করবে। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলেছে।’
বুলডোজার দিয়ে মুসলমানদের বাড়ি, মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আসাম, দিল্লি, মুম্বাই সব জায়গাতেই মুসলমানরা এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন । এসব বাড়ি ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার কোন আইনী বৈধতা বেশিরভাগ সময়েই থাকে না। মুসলমানদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়াকে হিন্দুরা ন্যায়বিচার বলে মেনে করছে।
শোয়েব জানান, ‘মৌলিক আইনী সুবিধা পাচ্ছেন না মুসলমানরা। তাদের গণহারে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। মুসলিম বিদ্বেষ ভারতের রাজনীতির একটা অংশ।’
রাজনীতি বিষয়ক সাংবাদিক ফাতিমা খান বলেন, এই ‘বুলডোজার জাস্টিস’ গণমাধ্যম খুব দ্রুত গ্রহণ করেছে এবং তা প্রচার করছে এটা খবই হতাশাজনক।
পরান গুহ ঠাকুরতা বলেন, এই বুলডোজার এখন হিন্দু জাতিয়াবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।