Image description

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন দেশটির আওয়ামী লীগের সদস্যরা। টিউলিপ সিদ্দিকের দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষাপটে দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য সামনে এসেছে।

বুধবার (৮ জানুয়ারি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ সিদ্দিকের খালা শেখ হাসিনা সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলের সদস্যরা কিয়ার স্টারমারকে পার্লামেন্ট নির্বাচনে জেতাতে সক্রিয় ছিলেন। এ কাজটি মূলত করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার নেতাকর্মীরা। এমনকি কিয়ার স্টারমারের জন্য তহবিল সংগ্রহের নৈশভোজেও তারা যোগ দিয়েছিলেন।

গত ১৫ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার এবং গুম করে আয়নাঘরে রাখাসহ বহু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে দলটির নেতাকর্মী ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন। সেই দলটির নাম এবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জড়াচ্ছে।

এ আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার নেতাকর্মীরা টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষেও নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। টিউলিপের বিজয় নিশ্চিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন তারা। এর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য কারণ, তিনি দলটির প্রধান শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে।

দীর্ঘসময় ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি সে দেশের পার্লামেন্টে লেবার পার্টির একজন সদস্য ও বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি)। এ পদে দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে আছেন তিনি। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে দুর্নীতির তদন্তে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নাম জড়িয়েছে তারও। শেখ হাসিনার আমলে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে বিনামূল্যে ফ্ল্যাট পাওয়ার তথ্য সামনে আসার পর যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বেশ চাপে পড়েন তিনি।

প্রশাসনিক নীতিনির্ধারণে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বেশ কঠোর বলেই পরিচিত। কিন্তু টিউলিপের ফ্ল্যাট নেওয়ার ইস্যুতে তিনি এখনো চুপ। এ আলোচনা গড়িয়েছে কিয়ার স্টারমার ও টিউলিপের দীর্ঘ রাজনৈতিক সম্পর্কে। ঘাঁটা হচ্ছে অতীত। এমন বিশ্লেষণেই টেলিগ্রাফ বর্তমান দুর্নীতির সূত্র মিলিয়েছে।

এখন এটা প্রকাশ্যে এসেছে যে, ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা কিয়ারের পক্ষে হলবর্ন এবং সেন্ট প্যানক্রাস নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আহাদ চৌধুরী। কিয়ারের নির্বাচনী এলাকা টিউলিপ সিদ্দিকের হ্যাম্পস্টেডের পাশে অবস্থিত। দলটির নেতাকর্মীরা দুজনের জন্যই সমানতালে কাজ করেন।

ওই সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা কিয়ার স্টারমারের নাম সংবলিত লেবার পার্টির লিফলেট বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। এ কাজে যাওয়া অনেকে লেবার পার্টির সমর্থনে প্ল্যাকার্ড বহন করেন এবং ছবি তুলেন।

তারা একই দিনগুলোতে টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষেও প্রচারণা চালিয়েছিলেন। অন্যান্য প্রচারণাকারীদের মধ্যে এমন কর্মীরাও ছিলেন যারা সরাসরি সদস্য না হলেও প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন অথবা নিজেদের দলের লোক বলে পরিচয় দিতেন।

প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বেশ কয়েকবার আব্দুল আহাদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত কিয়ারের জন্য এক তহবিল সংগ্রহ নৈশভোজেও তাদের দেখা হয়।

গত বছরের জুলাই মাসে সাধারণ নির্বাচনের দিন আব্দুল আহাদ চৌধুরী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে করমর্দনের একটি ছবি পোস্ট করেন। যার ক্যাপশন ছিল, ‘ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় কিয়ার স্টারমার।’ ছবিটি কখন তোলা হয়েছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এ ছাড়া ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় কিয়ার ইলফোর্ডে লেবার প্রার্থী স্যাম ট্যারির পক্ষে প্রচারণা চালাতে যান। ওই সময় আব্দুল শহীদ শেখ নামে একজনের সঙ্গে পোজ দেন। শহীদ নিজেকে আওয়ামী লীগের জনসংযোগে কাজ করছেন বলে বর্ণনা করতেন। এই লোক বর্তমানে উপপ্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা রেনারের সঙ্গেও দেখা করেছেন।

এ ছাড়া প্রতিবেদনটিতে আরও অনেক আওয়ামী লীগের নেতার নাম উঠে এসেছে। তাদের সঙ্গেও কিয়ার স্টারমারের ছবি রয়েছে। এ দলটিই টিউলিপের নির্বাচনী জয় নিশ্চিতে দিনরাত খেটেছেন।

এদিকে বর্তমানে টিউলিপ ইস্যুতে ডাউনিং স্ট্রিট সরগরম। যুক্তরাজ্যের সরকারের অনেকেই এ নিয়ে সমালোচনা করছেন। বিভিন্ন মহল থেকে তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। টিউলিপের খালা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নিপীড়নের আলোচনাও ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছেছে। সেই দলের সঙ্গে টিউলিপের যোগসূত্র থাকা এবং সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে একাধিক সম্পত্তি ভোগ নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে তিনিই বর্তমানে দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় আলোচনা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।

কিন্তু বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরও কিয়ার টিউলিপেরে পাশেই দাঁড়িয়েছেন। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, তাদের মধ্যে দীর্ঘ সম্পর্কের কথা। কিয়ারের তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বন্ধুর প্রতি আনুগত্যশীল। টিউলিপকে সেই পক্ষেরই একজন বলা হচ্ছে।

এই জুটির রাজনৈতিক বন্ধন ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়। তখন টিউলিপ ইতিমধ্যেই হ্যাম্পস্টেড এবং কিলবার্নে লেবারের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। অপরদিকে প্রতিবেশী হলবর্ন এবং সেন্ট প্যানক্রাসে বিজয়ের জন্য লড়ছিলেন স্যার কিয়ার। টিউলিপ সে সময় কিয়ারের পাশে দাঁড়ান।

২০১৫ সালের নির্বাচনে একই রাতে তারা একসঙ্গে পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন। সেই বছরের শেষের দিকে ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থীকে সমর্থন করা সত্ত্বেও উভয়ই জেরেমি করবিনের অধীনে সামনের বেঞ্চে বসেছিলেন।

২০২০ সালের গোড়ার দিকে যখন দলের শীর্ষ পদটি নির্বাচনের সময় এলো তখন টিউলিপই প্রথম লেবার এমপিদের একজন; যিনি স্যার কিয়ারকে প্রকাশ্যে নেতা হিসেবে মনোনীত করেন। এমনকি তার প্রার্থিতাকে লেবার ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশও সমর্থন করে। এ গ্রুপটি দলীয় চাপ বৃদ্ধিতে বেশ সহায়কের ভূমিকায় ছিল। এটা স্পষ্ট যে, টিউলিপের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাতেই গ্রুপটি কিয়ারকে সমর্থন দেয়।

টিউলিপ বিভিন্ন সময় স্টারমারের পাশে বন্ধুর মতো থাকার কথা সংবাদমাধ্যমে বলেছেন। এ জয়ের পেছনে তার ভূমিকা নিয়েও তিনি প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন।