
ইসরাইল পশ্চিমা উপনিবেশিক যুদ্ধকৌশল রপ্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ দমনে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও এর ফল ভোগ করছে ফিলিস্তিনিরা। সমাজবিজ্ঞান গবেষক ম্যাথ্যু রিগুস্ত মিডল ইস্ট মনিটরের এক মতামত প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ফিলিস্তিন আজ সাম্রাজ্যবাদী বুমেরাংয়ের ধাক্কা সবচেয়ে বেশি সহ্য করছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের যুগে আধিপত্যবাদী শাসনব্যবস্থাগুলো প্রতিরোধের মুখে টিকে থাকতে যুদ্ধ, নজরদারি এবং দমন-পীড়নের কৌশলগুলো উপনিবেশিক ও কেন্দ্রীয় যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া শুরু থেকেই ফিলিস্তিন উপনিবেশের মূল চালিকাশক্তি হয়ে থাকলেও, তা ‘প্রতিরোধের নান্দনিকতা’ মুছে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শাসনামলের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনে ঔপনিবেশিক আধিপত্য বারবার প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। শাসন টিকিয়ে রাখতে উপনিবেশকারীরা ‘কাউন্টার-ইনসারজেন্সি’ বা প্রতিপক্ষ জনগণের ভিতরেই যুদ্ধের কৌশল প্রয়োগ করে—যা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ইতিহাসে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া বিশেষ করে গতি পায় ১৯৩৬-৩৯ সালের আরব বিদ্রোহের সময়, যেখানে ফিলিস্তিনি জনগণ ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও তার জায়োনবাদপ্রীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।
তৎকালীন ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা চার্লস টেগার্টকে, যিনি এর আগে আয়ারল্যান্ড ও কলকাতায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে বর্বর নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিলেন, ১৯৩৭ সালে ফিলিস্তিনে পাঠানো হয়। তিনি নির্মাণ করেন সুরক্ষিত পুলিশ স্টেশন, সীমান্ত বেড়া এবং নির্যাতন কেন্দ্র।
অন্যদিকে, ভারতীয় ব্রিটিশ পরিবারে জন্ম নেওয়া জেনারেল অর্ড উইনগেট সুদানে কর্মরত ছিলেন, পরে ফিলিস্তিনে গিয়ে ‘স্পেশাল নাইট স্কোয়াডস’ গড়ে তোলেন—যা ছিল ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের নিয়ে গঠিত দমনমূলক বাহিনী। এই প্যারামিলিটারি গোষ্ঠী পরবর্তীতে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করে।
ম্যাথ্যু রিগুস্ত আরো লেখেন, ফরাসি ঔপনিবেশিক কৌশলগুলোরও ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। যেমন—হাইতিতে দাসপ্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে কুকুর ব্যবহার করে বিদ্রোহীদের শিকার, সিরিয়া ও আলজেরিয়ায় যেভাবে গণতালিকা, গণগ্রেপ্তার, প্রশাসনিক আটক, নির্যাতন, দলগত শাস্তি, নির্বাসন ও তাৎক্ষণিক হত্যাকাণ্ড চালানো হতো—এই সমস্ত কৌশল পরবর্তীতে ইসরাইলি নিরাপত্তা কাঠামোয় একীভূত হয়। তবুও, এই কৌশলগুলো ফিলিস্তিনিদের দৃঢ়তা বা প্রতিরোধের চেতনা দমন করতে পারেনি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর গণহত্যার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। গাজায় ধ্বংস হচ্ছে ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থী ক্যাম্প ও জীবনরক্ষাকারী অবকাঠামো। খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে, যা ব্রিটিশদের দক্ষিণ আফ্রিকায়, আর মার্কিনদের কিউবা, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামে ব্যবহৃত ‘খাদ্য ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ’ কৌশলের প্রতিধ্বনি। ইসরাইল এটিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘মানবিক সহায়তা’কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে—ক্ষুধার্ত জনগণের ওপর গণহত্যা চালাতে।
রাসায়নিক যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক প্রতিরোধ
সাদা ফসফরাস, বিষাক্ত গ্যাস ইত্যাদি ফিলিস্তিনকে বাসযোগ্যতা থেকে বঞ্চিত করছে। এই কৌশল আগে ব্যবহৃত হয়েছে মরক্কোর রিফে ফরাসি ও স্প্যানিশদের দ্বারা, আবার আলজেরিয়া ও ভিয়েতনামে মার্কিনদের দ্বারা। এইসব যুদ্ধক্ষেত্রে ‘জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুধুই রক্তপাত ঘটিয়েছে—যদিও সামরিক-নিরাপত্তা শিল্প লাভবান হয়েছে। কিন্তু চূর্ণ করতে পারেনি নিপীড়িতদের প্রতিরোধ-চেতনাকে। হাইতি, ভিয়েতনাম বা আলজেরিয়ার মতোই, ফিলিস্তিন এখন সেই প্রতীক—যে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ-বিরোধী সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সীমান্ত অতিক্রম করে, সাম্রাজ্যবাদী বুমেরাংয়ের মুখে ফিলিস্তিনের নাম এখন আন্তর্জাতিক সংহতির প্রতীক—যা প্রমাণ করে, নিপীড়িতরা বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একত্রিত হতে এবং প্রতিরোধ করতে পারে।