
২০২৪ সালের ৩ জুন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত গাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের স্মরণে একটি প্রতীকী সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন গণহত্যাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। অনুষ্ঠানে আরবি ভাষায় লেখা সার্টিফিকেট, ফুল ও গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপ রাখা হয় সাদা চেয়ারগুলোর ওপর।
অথচ এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিশ্বের ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার নিরপেক্ষতার মুখোশে এমন এক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত, যা বর্তমানে একটি গণহত্যামূলক মোডে চলছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বস্তুত উপনিবেশবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো এবং অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল।’ জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেসকা আলবানিজ তাঁর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছেন।
‘ফ্রম ইকোনমি অব অকুপেশন টু ইকোনমি অফ জেনোসাইড (From economy of occupation to economy of genocide)’ শিরোনামের প্রতিবেদনে আলবানিজ তুলে ধরেছেন কীভাবে ইসরায়েলের চলমান গণহত্যায় আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র সরকার আলবানিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটিকে তিনি যথার্থভাবেই ‘জঘন্য’ ও ‘মাফিয়া ধরনের ভীতি প্রদর্শন কৌশল’ হিসেবে অভিহিত করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ও যুদ্ধযন্ত্র
প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের তহবিল ইসরায়েলি সামরিক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করছে এবং সামরিক গবেষণাকে সমর্থন করছে। এটি কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে গভীরভাবে প্রোথিত গণহত্যায় সহযোগিতাই নয়, বরং এটাও মনে করিয়ে দেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক ও গবেষকেরাও আন্তর্জাতিক আইনে দায়বদ্ধ।
আলবানিজ বলছেন, আইন, প্রত্নতত্ত্ব, ও মধ্যপ্রাচ্য গবেষণার মতো হিউম্যানিটিজ বিষয়গুলো ‘নাকবা’র ইতিহাসকে ধুয়ে-মুছে ঔপনিবেশিক বয়ানে রূপান্তর করে, যা একটি ‘গণহত্যামূলক যন্ত্রে’ রূপান্তরিত জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রকে বৈধতা দেয়। যেমন এসটিইএ’র বিষয়গুলো সরাসরি এলবিট সিস্টেমস, ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ, আইবিএম, লকহিড মার্টিনের মতো সামরিক শিল্প কোম্পানির সঙ্গে গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ড্রোন স্কোয়াডসহ নানা সামরিক গবেষণা চলছে। যুক্তরাজ্যে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় তার আড়ািই শতাংশ তহবিল এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, যারা ইসরায়েলি সামরিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে।
কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা
আলবানিজের প্রতিবেদনে কোনো কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই, লেখকদের মতে সেগুলোকেও অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বিশেষ করে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় গত এক দশকে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমাগত গভীর করেছে। মানবিক বিজ্ঞান থেকে সাইবার নিরাপত্তা পর্যন্ত নানা খাতে এ সম্পর্ক বিস্তৃত। বহু দাতা ব্যক্তি ও সংস্থা, যাদের ইসরায়েলি সহযোগী কোম্পানির সঙ্গে যোগ আছে, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলেছে—যা ‘কানাডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি টিচার্স’-এর সমালোচনারও কারণ হয়েছে।
উচ্চশিক্ষায় সরকারি অর্থায়ন কমে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন দাতাদের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে, যা এ হস্তক্ষেপের পথ করে দিয়েছে। গণহত্যার বিরুদ্ধে ডাক ওঠার পর টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় আরও বেশি করে ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক প্রকল্প, ছাত্র বিনিময় কর্মসূচি ও গবেষণা তহবিল চালু করেছে। ‘আর্কিওলজি অব ইসরায়েল ট্রাস্ট’ নামের তহবিলও চালু আছে। এটি এমন এক প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চাকে সহায়তা করে, যা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদকে বৈধতা দেয়।
বিনিয়োগের মাধ্যমে সহযোগিতা
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়-এর ‘Asset Management Corporation (ইউটিএএম)’ এমন বহু কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, যেগুলো আলবানিজের মতে, গণহত্যায় সহযোগী। যেমন: এয়ারবিএনবি, আলফাবেট, ক্যাটারপিলার, এলবিট সিস্টেম, লকহিড মার্টিন প্রভৃতি। ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৫৫টি সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে কাজ করে। ইউটিএএম-এর ৪৪টি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপকের মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩.৯৫ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার বিনিয়োগ করেছে ১১টি কোম্পানিতে, যেগুলো জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ওএইচসিএইচআর) দ্বারা অবৈধ বসতি নির্মাণে সহযোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক
ওয়েস্টার্ণ ইউনিভার্সিটি প্রায় ১৬ মিলিয়ন ডলার সামরিক ঠিকাদার কোম্পানিতে এবং ৫০ মিলিয়নেরও বেশি ডলার এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, যারা ফিলিস্তিন দখল ও গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিও লকহিড মার্টিন, এয়ারবাস, বিএই সিস্টেমস, সাফরান, থালাস-এর মতো সামরিক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে।
এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মীরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি আন্তর্জাতিক আইনে যথার্থ এবং আইনত বাধ্যতামূলকও বটে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকদের আইনি দায় আলবানিজ জোর দিয়ে বলেন: ‘একটি রাষ্ট্র মানবাধিকার না মানলেও, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মানবাধিকার মানতেই হবে। কেবল দেশীয় আইনের অনুসরণ করাই আন্তর্জাতিক দায় থেকে অব্যাহতি দেয় না।’
এর মানে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আছেন, তারা যদি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করেন এবং এর পরিবর্তে এসব বিষয়ে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের দমন করেন, তবে তারাও গণহত্যায় সহায়তার দায়ে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পড়েন।
সবশেষে আলবানিজ সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘করপোরেট খাত, তার নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে। এটাই গণহত্যা বন্ধের এবং তা সম্ভব করা পুঁজিভিত্তিক বর্ণবাদী কাঠামো ভেঙে দেওয়ার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আমাদের দায়িত্ব এ জবাবদিহি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নিশ্চিত করা।’
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ