Image description
 

২০২৫ অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট বরাদ্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এত বিপুল ব্যয় সত্ত্বেও ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে সমর্থন এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে গিয়ে দেশটির কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তি কার্যত টালমাটাল।

একসাথে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক ফ্রন্ট সামলাতে গিয়ে ওয়াশিংটনের প্রভাব বিস্তার নীতির সীমাবদ্ধতা এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

চীন বা রাশিয়ার মতো শক্তিশালী দেশগুলোকে সামরিক শক্তিতে হারাতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেই তুলনায় দেশটি সামরিক উৎপাদন বাড়াতে পারছে না। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ এখনো নানাভাবে চীনের ওপরই নির্ভরশীল। ওয়াশিংটনভিত্তিক ডেটা অ্যানালিটিক্স ফার্ম গোভিনি ২০২৫ সালের জাতীয় নিরাপত্তা স্কোরকার্ড প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে মার্কিন সামরিক প্রস্তুতির এমন বেহাল দশা উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মসূচির প্রধান নয়টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রথম সারির কনট্রাক্টরদের ৯ দশমিক ৩ শতাংশই চীনা প্রতিষ্ঠান। এদিকে, রাশিয়া ও চীনের মতো মার্কিন প্রতিপক্ষরা যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য অনেক ভালোভাবে প্রস্তুত।

প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মসূচির প্রধান নয়টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের মধ্যে প্রায় ৯ দশমিক ৩ শতাংশই চীনা মালিকানাধীন বা চীনের প্রভাবাধীন প্রতিষ্ঠান। এতে মার্কিন প্রতিরক্ষা খাতে একপ্রকার ‘গোপন নির্ভরতা’ তৈরি হয়েছে চীনের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু নিরাপত্তা ঝুঁকিই নয়, বরং কৌশলগত দিক থেকেও মারাত্মক দুর্বলতা।

অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীনের মতো মার্কিন প্রতিপক্ষরা যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য অনেক বেশি প্রস্তুত, সংগঠিত এবং প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর। ফলে সামরিক বাজেট বিপুল হলেও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র এখন একধরনের কৌশলগত অস্থিরতার মুখোমুখি।

গত তিন দশক ধরে চীন তার সামরিক প্রস্তুতিকে আধুনিক করেছে। এর জন্য ২০২৪ সালে আনুমানিক ২৩৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে দেশটি। রাশিয়া ২০২২ সাল থেকে আর্টিলারি শেল উৎপাদন পাঁচগুণ বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এর ধারেকাছেও নেই। অথচ দেশটি সামরিক শিল্পে কয়েক দশক ধরে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, খুচরা যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের জন্য বিদেশি সরবরাহকারী, এমনকি শত্রু দেশগুলোর কাছেই তাকে হাত পাততে হয়।

বিমান, সামুদ্রিক, স্থল, মহাকাশ, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক, মিশন সহায়তা, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ, কম্পিউটার এবং গোয়েন্দা ব্যবস্থার জন্য এখনো যুক্তরাষ্ট্র বিদেশনির্ভর। বিশেষ করে চীনের ওপর। এখন চীন যদি আজই যুদ্ধে নামতে চায়, তাহলে দেশটিকে মোকাবিলার প্রস্তুতি যুক্তরাষ্ট্রের একেবারেই নেই।

প্রতিবেদন অনুসারে, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা খাতের চীনা সরবরাহকারীদের ওপর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নির্ভরতা ছিল। পরিমাণটি ১১ দশমিক ১ শতাংশ। পারমাণবিক খাতের চীনের ওপর নির্ভরতা ছিল সবচেয়ে কম, ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তারপরও ওই খাতে চীনের সরবরাহকারীর সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৫৩৪। যুক্তরাজ্যের বেলায় সংখ্যাটি ৩৬৬। জাপানের বেলায় ২৩০ আর কানাডার ক্ষেত্রে ৪০৫।

একইভাবে, যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ শৃঙ্খলে, চীনা সরবরাহকারীদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা ছিল ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। স্থল ব্যবস্থায় চীনের উপর মার্কিন নির্ভরতা ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। আর সামুদ্রিক ক্ষেত্রে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, বিমান চলাচলে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মহাকাশে ৮ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থে জন্যও চীনের ওপর মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের গুরুতর নির্ভরতা আছে। ওইসব খনিজের অনেকগুলো শুধু চীনেই পাওয়া যায়।

গুরুত্বপূর্ণ পেটেন্ট নিবন্ধনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন অনেক এগিয়ে। যেমন, সংবেদনশীল পারমাণবিক ক্ষেত্রে চীন ২০২৪ সালে ২ লাখেরও বেশি পেটেন্ট দাখিল করেছিল। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় সংখ্যাটি প্রায় ৫০ হাজার। মহাকাশ খাতে ২০২৪ সালে চীন ৩ লাখেরও বেশি পেটেন্ট দাখিল করেছিল। একই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট দাখিলের পরিমাণ ছিল ১ লাখেরও কম।

সামগ্রিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকারীদের মাত্র ৩৭ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। প্রায় ১০ শতাংশ সরবরাহকারী এমন দেশগুলোয় অবস্থিত, যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো নয়। তাদের প্রায় ৯ শতাংশ কেবল চীনে অবস্থিত। ৩৫ শতাংশ সরবরাহকারী মিত্র দেশগুলোতে অবস্থিত। ১৮ শতাংশ সরবরাহকারী ভারতের মতো নিরপেক্ষ দেশগুলোয় অবস্থিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন চীননির্ভরতা কমানোর কোনো সহজ পথ আপাতত নেই। গোভিনির প্রধান নির্বাহী মারফি ডগার্টি বলেছেন, মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যয় রেকর্ড পর্যায়ে থাকলেও, যুদ্ধক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা এখনো প্রয়োজনীয় গতিতে সরবরাহ করতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র।