Image description

দুই হাজার দশকের শেষ দিকে যখন দ্য হাংগার গেমস বইগুলো প্রকাশিত হয়, তখন হয়তো কেউ কল্পনাও করেননি যে সেই উপন্যাসের বিভীষিকাময় দৃশ্য একদিন বাস্তব হয়ে দাঁড়াবে আমাদের চারপাশে। কিন্তু এখন প্রতিদিনই সেই দৃশ্য বাস্তব হচ্ছে গাজায়। গত মার্চের শুরু থেকে আমরা সম্পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের অধীনে দিন কাটাচ্ছি। খাদ্য অভাব গাজার পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। অধিকাংশ পরিবার দিনে মাত্র একবার খেতে পাচ্ছে। কেউ কেউ দিনের পর দিন না খেয়ে আছে।

মে মাসের শেষ দিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) সীমিত পরিমাণে কিছু ত্রাণ বিতরণ শুরু করে। এরপর থেকে গাজাবাসী যেন এক ভয়াবহ মৃত্যু খেলায় নেমেছে কিছু খাবার পাওয়ার জন্য। আমার পরিবারের কেউ এখন পর্যন্ত জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণ স্থলে যাওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু আমার প্রতিবেশী ও বন্ধুদের কেউ কেউ গিয়েছেন। তারা যা দেখেছে, শুনেছে তা একেকটি বিভীষিকাময় গল্প।

প্রথম যখন আমরা শুনলাম ইসরায়েলিরা যাকে “নেতসারিম করিডোর” বলছে, সেখানকার ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে তখন কল্পনা করেছিলাম হয়তো সারি সারি তাঁবু থাকবে, লাইন, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা থাকবে। কিন্তু যারা সেখানে গেছেন, তারা ফিরেছেন মৃত্যু ও বিশৃঙ্খলার গল্প নিয়ে। ত্রাণ বিতরণ হয় গাজার পূর্ব প্রান্তে সালাহউদ্দিন সড়কের কাছে একটি ঘেরা জায়গায় যেটিকে স্থানীয়রা "মৃত্যুর করিডোর" নামে ডাকেন। চারপাশে বালুর পাহাড়, ঘেরা প্রাচীর, এবং বিদেশি সামরিক ঠিকাদারদের কঠোর প্রহরা। আশেপাশে থাকে ইসরায়েলি ট্যাংক ও সেনা।

ত্রাণ বিতরণের নির্দিষ্ট কোনো সময়সূচি নেই। কখনো ভোর ৪টায় গেট খোলে, কখনো তারও পরে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা আগের রাত থেকেই সেখানে অপেক্ষা করতে শুরু করে। গেট খুললে, ভিড় ছুটে আসে। কোনো লাইন নেই, কোনো কর্মী নেই, কোনো দিকনির্দেশনা নেই। শুধু ধুলো, চিৎকার, আর ভয়। উপরে ড্রোন ঘোরে শকুনের মতো। এরপর হঠাৎ মাইক থেকে গর্জে ওঠে এক কণ্ঠস্বর: চার মিনিট! যত পারো নিয়ে নাও! ত্রাণের বাক্সগুলো বালুর মাঝে ফেলে রাখা হয়, কিন্তু তা কখনোই যথেষ্ট নয়। সবাই ছুটে যায়, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়, ছুরি বের হয়, হাতাহাতি, চিৎকার, কান্না। পুরুষ পড়ে যায়, নারী বালুর মধ্যে হামাগুড়ি দেয়। কেউ কেউ ভাগ্যবান বাক্স পায়। তারপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়।

ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গুলি। কেউ দৌড়ে পালায়, কেউ গুলিবিদ্ধ হয়, কেউ মারা যায়। কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় হামাগুড়িয়ে পালায়, কেউ হয়তো বন্ধু বা অপরিচিত মানুষের সাহায্যে বাঁচে, আর কেউ একাকী রক্তে ভিজে মাটিতে পড়ে থাকে। মে মাসের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত সাহায্য কেন্দ্রে গুলিবর্ষণের ঘটনায় ৫ শতাধিকের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন । আহত হয়েছেন ৪,০০০ জনের বেশি।

আমার বন্ধু নূরের বাবা সুবহি ছিলেন সেই হতাহতদের একজন। ১৪ জুন সকালে তিনি নেতসারিম ত্রাণকেন্দ্রে রওনা দেন। তিনি আর ফিরে আসেননি। পরে তার নিথর দেহ পাওয়া যায় তিনি নিজের সন্তানদের জন্য খাবার আনতে গিয়ে প্রাণ হারান। আরেক বন্ধু হালার আত্মীয় খামিসের কথাও বলি। মাত্র দুই বছর আগে বিয়ে করেছিলেন। সন্তান হয়নি। কিন্তু যুদ্ধের শুরুতে ভাই নিহত হওয়ার পর, তার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। খাবার না থাকায় বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলেন aid hub-এ। ২৪ জুন সকালে, তিনি একটু উঁকি দিতেই একটি কোয়াডকপ্টার থেকে গুলিতে নিহত হন  গুলিটি প্রথমে কাঁধে, পরে হৃদয়ে। এমন আরও অসংখ্য হৃদয়বিদারক গল্প আছে, যেগুলো হয়তো কোনোদিন জানা যাবে না।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই ঘটনাগুলোকে ত্রাণ হত্যাকাণ্ড বলেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এগুলো যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু এদের আসল নাম ‘হাংগার গেমস’ ক্ষুধা দিয়ে তৈরি এক নিষ্ঠুর খেলায় মানুষকে ঠেলে দেওয়া। ক্ষুধা শুধু শরীরকে দুর্বল করে না আত্মাকেও ভেঙে দেয়। এটি মানুষের মধ্যকার আস্থা ও সংহতি ধ্বংস করে, মানুষকে পশুর মতো লড়াই করতে বাধ্য করে। দখলদার তা জানে এবং সেই জ্ঞানকে অস্ত্র বানিয়েছে।

তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে UNRWA-এর মতো বিশ্বস্ত সংস্থার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে, যারা সংস্থাপনাপূর্ণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও ন্যায্যভাবে ত্রাণ বিতরণ করত। পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে যারা সবচেয়ে অসহায় বিধবা, এতিম, বৃদ্ধ তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। সে ব্যবস্থায় ছিল সম্মান, মানবতা এবং শৃঙ্খলা। কিন্তু দখলদার তা চায় না। তারা চায় বিশৃঙ্খলা। তারা চায়, ফিলিস্তিনিরা একে অপরকে মারুক, তাদের সমাজ ভেঙে পড়ুক।

এক মাস ধরে ইসরায়েল ও জিএইচএফ এই গণহত্যার ঘটনা অস্বীকার করেছিল। এখন ইসরায়েলি মিডিয়াই স্বীকার করছে ইসরায়েলি সেনাদের জনতার ওপর গুলি চালানোর আদেশ ছিল। এখন কি বিশ্ব আমাদের বিশ্বাস করবে? নাকি আবারও নীরব থাকবে? গাজায় যা ঘটছে, তা কল্পকাহিনি নয়। এটি কোনো হরর সিনেমা নয়। এটি বাস্তব। এটি গণহত্যা। বিশ্ব যদি তা থামাতে কিছু না করে, তবে তা প্রমাণ করে মানবতা হারিয়ে গেছে।

গাজার লেখক ও কবি তাকওয়া আহমেদ আল-ওয়াওয়ির লেখা আলজাজিরা থেকে অনুবাদ