
টানা ১২ দিন তীব্র পাল্টাপাল্টি হামলার পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ইরান ও ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত হামলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই দেশ। এতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে স্বস্তির সুবাতাস বইছে। স্বস্তি প্রকাশ করেছে ইরান ও ইসরায়েলের মানুষ। যুদ্ধবিরতির খবর পেয়ে ইরানের রাশত এলাকা থেকে তেহরানে ফিরছিলেন রেজা শরিফি নামে এক ব্যক্তি। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমরা খুব খুশি। যে-ই মধ্যস্থতা করুন না কেন, তা কোনো বিষয় নয়। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, সেটিই আসল বিষয়।’ আর তেল আবিবের বাসিন্দা আরিক দাইমান্ত বলেন, ‘আমি আশা করি এ যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে নতুন দিনের সূচনা হবে।’
হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি পরিবহন করা হয়। গতকাল যুদ্ধবিরতির পর এএফপি জানায়, প্রণালিটি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে তেহরান। নরওয়েভিত্তিক জ্বালানি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিস্টাড এনার্জির গবেষক জর্জ লিওন এএফপিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, হরমুজ প্রণালি বন্ধের ঝুঁকি এখন দ্রুত কমে এসেছে। কারণ ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।’
যুদ্ধবিরতিতে স্বস্তি প্রকাশ করেছে বিভিন্ন দেশও। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘সত্যিকারের একটি যুদ্ধবিরতির’ আশা করছে বেইজিং। এ যুদ্ধবিরতি যেন টেকসই হয়, সে আশা প্রকাশ করেছে রাশিয়াও। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানান তাঁরা।
যেভাবে যুদ্ধবিরতি : ২৩ জুন রাতে কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে যখন ইরান হামলা চালায়, তখন হোয়াইট হাউসের ‘সিচুয়েশন রুমে’ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ছিলেন ট্রাম্প। ওই হামলার কয়েক ঘণ্টা পর ট্রুথ সোশ্যালে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প বলেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। তাঁর ঘোষণার ৬ ঘণ্টা পর ইরান প্রথম যুদ্ধবিরতি শুরু করবে। এর ১২ ঘণ্টা পর যুদ্ধবিরতি শুরু করবে ইসরায়েল। এক পক্ষের যুদ্ধবিরতির সময় অন্য পক্ষ এর প্রতি সম্মান জানাবে। এভাবে মোট ২৪ ঘণ্টা পর ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ শেষ হবে।
হোয়াইট হাউসের বরাতে আলজাজিরার খবরে বলা হয়, যুদ্ধবিরতিতে নেতানিয়াহুকে রাজি করানোর জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। নেতানিয়াহু রাজি হওয়ার পর তিনি ফোন করেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে। অনুরোধ করেন, যুদ্ধবিরতিতে ইরানকে রাজি করানোর জন্য। কাতারের আহ্বানে রাজি হয় তেহরান। এ সময় ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফও।
সাত শতাধিক ইসরায়েলি গুপ্তচর গ্রেপ্তারের দাবি ইরানের : ইরানে ইসরায়েলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৭০০ জনেরও বেশি সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে ইরান। গত ১২ দিনের ইরান-ইসরায়েলের সংঘাতের সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। ইরানের বিভিন্ন প্রদেশ-কেরমানশাহ, ইসফাহান, খুজেস্তান, ফার্স ও লোরেস্তানে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তবে রাজধানী তেহরানে কতজনকে আটক করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ফার্স নিউজ ও নুরনিউজের জানিয়েছে, গ্রেপ্তাররা মূলত গোয়েন্দা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে একটি অভিযান পরিচালনার কথা স্বীকার করেছে এবং এর আওতায় ইরানের অভ্যন্তরে গোপন কার্যক্রমের ভিডিও প্রকাশ করেছে।
এ ঘটনার পর ইরানে নিরাপত্তা সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বেড়েছে। ইসরায়েলপন্থি পোস্ট শেয়ারের অভিযোগে আরও অনেককে আটক করা হয়েছে। তেহরানে ইতোমধ্যে একটি বিশেষ প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন করা হয়েছে এসব মামলার বিচারকাজ পরিচালনার জন্য।
এদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ধরনের গণগ্রেপ্তারের আইনি স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিছু প্রতিবেদনে একাধিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকরেরও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যদিও এসব তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।