
তেহরানে আলজাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মার্জিয়া আলী সালসাবিল।
ইসরাইলের ইরান হামলার সেই ভয়াল রাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে সোমবার যুগান্তরে লিখলেন তেহরানে আলজাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মার্জিয়া আলী সালসাবিল।
ভয়ংকর সই ভোর। লিখতে বসে এখনো গা শিউরে উঠছে আমার। ১৩ জুন, শুক্রবার ভোর রাত। ফজরের ঠিক কাছাকাছি সময়। পড়ালেখার চাপ চলছিল। পুরো রাত জেগেইছিলাম সেদিন। হঠাৎ বিকট শব্দ। পরপর দুটি। কি ভয়ংকর সে আওয়াজ। একেবারেই অপরিচিত।
মনে হলো যেন গমগম করে উঠল চার পাশ। কেঁপে উঠলে কান। ভয়ে হকচকিয়ে উঠেছিলাম প্রথমে। ভেবেছিলাম হয়তো বজ্রপাত হয়েছে। ইরানে এই সময়ে বৃষ্টি হয়।
বজ্রপাতও হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু আমার রুমমেট বলল, এটা বজ্রপাতের আওয়াজ নয়। বললাম এটা বজ্রপাতই হবে। যেহেতু আলোচনা চলছে, এখন হামলা হবে না। ১৫ তারিখেও একটি আলোচনা হওয়ার খবর পড়েছি। সেটা না হতেই কিভাবে হামলা হয়? বের হয়ে আকাশ দেখে নিশ্চিত হলাম- বজ্রপাত নয়। হামলাই হয়েছে। এরই মধ্যে আরও কয়েক দফা আওয়াজ শোনা যায়। একের পর এক কানফাটা শব্দ।
ততক্ষণে জেগে উঠেছে হোস্টেলের বাকিরাও। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। শব্দটা এত তীব্র ছিল যে, মনে হচ্ছিল এই বুঝি একটি পড়ল আমাদের হোস্টেলের ছাদে। দু-পা আগ বাড়িয়ে জানালার শিক ধরে কিংবা বেলকনিতে গিয়ে মাথাটা একটুখানি বের করে আবার আকাশটা দেখব- সে সাহসও আর পাচ্ছিলাম না আমরা।
সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয় (আলজাহরা) থেকে অ্যানাউন্সমেন্ট আসে যেন আমরা সবাই ফার্স্ট ফ্লোরে অবস্থান করি। মুহূর্তেই দৌড়-ছোটাছুটি। কান্নাকাটি হৈচৈ। হুড়মুড় করে নেমে পড়লাম সবাই। তখনো ক্রমাগত আমরা আমাদের মাথার উপর দিয়ে ফাইটার জেট যাওয়ার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। সে কি রুদ্ধশ্বাস সময়।
‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ’ বলে বইয়ের পাতায় পড়ে বড় হওয়া কথাটির বাস্তব দৃশ্যের সঙ্গে সেদিনই প্রথম দেখা হলো আমার।
সেদিন সকালেই আমাদের সবার মোবাইল সিমে ইরান গভর্নমেন্ট হতে এসএমএস আসে বর্তমান অবস্থা ও সতর্কতা নিয়ে। উল্লেখ করা হয় যে, প্রতিশোধ নেওয়া হবে এবং এই যুদ্ধের শেষ ইরানের হাতে লেখা হবে। এরপর আমরা নরমাল জীবনে ফিরে যাই যে যার কাজে। তেমন একটি অস্বাভাবিক কেউ আর ছিল না।
১৪ জুন মাঝরাতে আবার দুই দেশের পালটাপালটি হামলা শুরু হয়। আমাদের মাথার উপর দিয়ে আমরা একেকটা মিসাইল ভূপাতিত হতে দেখছিলাম। তবে কিছু মিসাইল আবার আঘাতও হানছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এরিয়া ইরানের একটি তেহরান শহরে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। ইরানের মিডিয়া, মিলিটারি অনেক ফ্যাসিলিটি এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা আমার ভার্সিটি এলাকায় তথা ভানাক এলাকায়।
‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ’ বলে বইয়ের পাতায় পড়ে বড় হওয়া কথাটির বাস্তব দৃশ্যের সঙ্গে সেদিনই প্রথম দেখা হলো আমার।
ওই মুহূর্তে আমরা অনেক ভয়ে ছিলাম। সবারই নির্ঘুম রাত, ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রাতযাপন। কিন্তু নেটিভ ইরানিয়ানদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না, তারা ছিল নিডর। তাদের যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভয় পাও না?’ তারা বলে, ‘আমরা বীরের জাতি। আমরা শাহাদাতের আকাঙ্খা রাখি। আমরা ভয় পাই না। আমাদের ইতিহাস এমনই।’
সেই রাতে আমাদের ভার্সিটি থেকে জানানো হয়, সেইফ বেসমেন্টের দিকে যেতে। ভার্সিটির একটু পেছনের দিকে বনজঙ্গলের মতো দেখতে জায়গায় অবস্থিত। সেখানে একটা গ্রাউন্ড ফ্লোর ছিল অনেক শব্দ, আওয়াজের মাঝে আমরা অনেক ভয়েই ছিলাম। তাই আমরা সেই বেসমেন্ট শিফট হয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও আমরা বাইরের অবস্থা আন্দাজ করা যাচ্ছিল। এই সিচুয়েশনে আমাদের অবস্থা অনেক খারাপ হয়েগিয়েছিল, আমরা প্রায় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। চার দিকের অবস্থা নিজের চোখে দেখে আমরা ট্রমাতে চলে গিয়েছিলাম। খাওয়া দাওয়া ঘুম সব প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।
‘আমরা বীরের জাতি। আমরা শাহাদাতের আকাঙ্খা রাখি। আমরা ভয় পাই না। আমাদের ইতিহাস এমনই।’
১৪ জুন সকালে ইরানে একটি ইসরাইলবিরোধী সমাবেশ হয়। সেখানে সব ইরানি জনগণ তাদের ইরানের পক্ষে অবস্থান করে এবং সভা সমাবেশ করে। তারা জীবনের পরওয়া না করে সেই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। তাদের চেহারায় ভয়ের কোনো ছাপ ছিল না। ১৬ জুন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৭ জুনের মধ্যে খালি করার নির্দেশ আসে।
তখন ইরানিরা তাদের বাসায়, পাকিস্তানিরা নিজ দেশে ফিরে যেতে থাকে, অন্য ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা অন্য শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন আবার তেহরানের ভানাক এলাকা মানে আমার ভার্সিটির এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আজকে হয়তো আমাদের জীবনের শেষ দিন হবে।
কিছুক্ষণ পর বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি থেকে কল আসে আমার কাছে যে, আমাকে একটি অন্য শহরে মোটামুটি একটি সেইফ বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাবে। অ্যাম্বাসি থেকে আমাকে সব খরচ বহনের দায়িত্ব নেওয়া হয়। যেই সময়ে আমি কারাজ শহরের সেইফ প্লেসে যাওয়ার জন্য রওনা হব সেই সময় হামলা শুরু হয়ে যায়। ফলে আমি আর যেতে পারি না। এর মধ্যে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাই। তখন আমার রুমমেট আমার সঙ্গে থেকে যায়, যে পাকিস্তানি ছিল। সে আমাকে নিজের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলে।
কারণ পাকিস্তান অ্যাম্বাসি বাস দিয়ে তাদের স্টুডেন্টদের পাকিস্তান বর্ডার পর্যন্ত বিনামূল্যে নিয়ে যাবে। ফলে আমি পাকিস্তানিদের সাথে তাদের অ্যাম্বাসিতে যাই। সেখান থেকে আমাকে বলা হয় তারা অবশ্যই আমাকে সাহায্য করবে কিন্তু আমার ভিসা অ্যাপ্লাই করা থাকতে হবে। পাকিস্তান অ্যাম্বাসি থেকে বের হওয়ার পর আমরা আর নিজের ক্যাম্পাসে ব্যাক করতে পারিনি। অবস্থা এত ভয়াবহ ছিল। ফলে আমি বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করি এবং তারা আমাকে সাহায্য করে। অ্যাম্বাসির এক কর্মকর্তার বাসায় আমি সেদিন রাতে আশ্রয় নেই আমার পাকিস্তানি ফ্রেন্ডের সঙ্গে।
আমি কোনোভাবেই ভিসা অ্যাপ্লাই করতে পারছিলাম না। কারণ তেহরান ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন ছিল। তাই আমি বাংলাদেশে আমার আব্বুকে বলি, যে ১৭ জুন সকালে আমার ভিসার জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে ফেলে। ১৭ জুন আমার ভিসা অ্যাপ্লাই হয়ে গেলে সেই ট্র্যাকিং নম্বর দিয়ে আমাকে পাকিস্তান যাওয়ার পারমিশন দিয়ে দেয় পাকিস্তান অ্যাম্বাসি এবং একদিনের মধ্যেই ভিসা ইস্যু করার প্রতিশ্র“তি দেয়। সেদিন আমাদের হোস্টেলও খালি করে দেওয়া হয়। ফলে আমার কাছে পাকিস্তান যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
পাকিস্তান অ্যাম্বাসিতে আমাকে আশ্বস্ত করা হয় যে, তারা আমার ভিসা পাকিস্তান বর্ডার পৌঁছানোর আগেই ইস্যু করে দেবেন এবং আমি যেন ঝামেলা ছাড়া বর্ডার ক্রস করতে পারি তারা নিশ্চিত করবেন। পরে আমি ভিসা পেয়েও যাই।
প্রায় ২৪ ঘণ্টা জার্নির পর আমরা পাকিস্তানের তফতান আর ইরানের জাহেদান বর্ডারের কাছে চলে আসি। আমরা ১৮ তারিখ রাত ৩টায় বর্ডার ক্রস করি এবং আমার ভার্সিটির পাকিস্তানি রুমমেটের বাসায় এসে উঠি। সেখানে ৩ দিন থাকার পর বাংলাদেশে ফিরে আসি।
একটি কথা না বললেই নয় ইরানিরা অনেক সাহসী। তারা নিজেদের জায়গা থেকে অনড়। তারা তাদের স্বাভাবিক জীবন খুবই স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। আর কথা বলতে বাংলাদেশে অ্যাম্বাসি থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার সমস্যাতে সাহায্য করা হয়েছিল। পাকিস্তান অ্যাম্বাসি আমাকে ইমার্জেন্সি ভিসা ইস্যু না করলে হয়তো আজকে আমি এভাবে দেশে ফিরতে পারতাম না। ইরানের অবস্থা অনেক বিভীষিকাময়। মানুষের দুর্ভোগ অনেকাংশে বেড়ে গেছে।
যেমন-পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস বন্ধ হয়েগিয়েছিল, জ্বালানি সঙ্কট শুরু হয়েগিয়েছিল অলরেডি। পুরো পৃথিবী ইসরাইলের অবস্থার দিকে হয়তো একটু বেশি নজর দিচ্ছে। তবে আমার চোখে আমি তেহরান ও ইরানের অবস্থা দেখে এসেছি। অবশ্যই অনেক ভয়াবহ এবং আমাদের জন্য অনেক নতুন। সবশেষে আলহামদুলিল্লাহ।