Image description

মব কালচার বা মবোক্রেসির প্রতি ঘৃণা জানাই। এটা অসভ্যতা, বর্বরতা, পৈশাচিকতা। এই ধারা গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুবিচারের পরিপন্থী। মবোক্রেসিকে নিরুৎসাহিত ও শাস্তিযোগ্য করতে হবে। আইনের শাসন ও  সুবিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং এই দুটি বিষয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে এনে এই জনতাতান্ত্রিক নৈরাজ্যের চির অবসান ঘটাতে হবে।

 

বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর মানুষের প্রতিশোধপ্রবণতা ও থাকে। অপরাধী ও বিভিন্ন প্রতিকী স্থাপনার ওপর সে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দেশে দেশে তার নজির আছে। কিন্তু তারা মাত্রা যেন সীমা না ছাড়ায় সেটা খেয়াল রাখতে হয়।

আমাদের দেশে ও সমাজে বেশিরভাগ মানুষ এই মবোক্রেসির বিরুদ্ধে। যদিও তারা অনেক সময়ে তাদের অনেকে হুজুগে মেতে কিংবা ক্রুদ্ধ বা প্ররোচিত হয়ে মবোক্র‍্যাটিক অ্যাকশনে শামিল হয়ে যায়। আমাদের দেশে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই মবোক্রেসিকে তাদের কর্তৃত্বস্থাপনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। তারা এই মবোক্রেসিকে জনগণের সংগঠিত আন্দোলন বলেও প্রচার করে।

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররাই এদেশে মবোক্রেসির জনক। তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের কথা বলে গণআদালত বসিয়ে প্রথম বড় ধরণের মবোক্রেসির ডেমনস্ট্রেশন করে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা গণকার্ফু জারি, জনতার মঞ্চ স্থাপন,  সচিবালয়ে হামলা, অফিসগামীদের উলঙ্গ করার মাধ্যমে আন্দোলন নাম দিয়ে যে নৈরাজ্য চালিয়েছিল তা ছিল শতভাগ মবোক্রেসি।

এরপর যুদ্ধাপরাধীদের সাজা হিসেবে ফাঁসি নির্ধারণ করে দিয়ে সেই রায় আদায়ের জন্য তারা শাহবাগের রাস্তায় টানা কয়েকমাস ধরে গণজাগরণমঞ্চ নামে মবোক্রেসির চরম নজির সৃষ্টি করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ও মুজিব হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের লাশের গাড়িতে আক্রমণ, জুতা ও ডিম নিক্ষেপ, জানাজা ও দাফনে বিপত্তি সৃষ্টি এবং কবরে হামলার ঘটনা ওরাই ঘটিয়েছে। রায় পছন্দ না হওয়ায় আদালত প্রাঙ্গণে বস্তি বসানো ও বিচারকদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিলও আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদেরই কীর্তি। বিচারপতি এম. এ আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে কী ধরণের হেনস্তার মুখে তারা পদত্যাগে বাধ্য করেছে তা ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের অন্তর্গত।

সবশেষে টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখে এই ফ্যাসিবাদীরা রাষ্ট্রশক্তির চরম অপপ্রয়োগ করে বিরোধী দলমতের ওপর হত্যা-নির্যাতনের পাশাপাশি যে-সব মবোক্র‍্যাটিক জুলুম ও অপমান চালিয়েছে তার কোনো লেখাজোখা নেই। এগুলোকে তারা জনতার রুদ্ররোষ বলে প্রচার করেছে। সেই মবোক্রেসির জনকেরাই কালচক্রে আজ মবোক্রেসির শিকার হচ্ছে। এখন ওরা যখন একই রকম অ্যাকশনেত শিকার হচ্ছে তখন তাদের দোসরেরা ‘গেল গেল সব রসাতলে গেল’ বলে শোরগোল তুলছে। ওরা বলছে, বাংলাদেশে নাকি অতীতে কখনো এমন কাণ্ড ঘটেনি! মবোক্রেসির বিরোধিতার পাশাপাশি এই মিথ্যাচার ও হিপোক্রেসিরও নিন্দা জানাতে হবে।

১৬ বছর ধরে কর্তৃত্ব করা ফ্যাসিবাদ অনেকের মধ্যেই ফ্যাসিবাদী ধ্যান-ধারণাকে সংক্রমিত করে গেছে। আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে গেছে। মবোক্রেসির এগুলোই কারণ। তাছাড়া বলপ্রয়োগে সাধিত পরিবর্তনের পর দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন কাজ। তবুও খুব শক্ত হাতে এই মবোক্রেসির রাশ টেনে ধরতে হবে। কাউকেই আর আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেওয়া যাবে না। কোনো দেশেই বিপ্লবের পর ক্রোধ ও প্রতিশোধস্পৃহাকে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে দেওয়া হয়নি। এখানেও চলতে দেওয়া যাবে না। আইনের শাসন ও সুবিচার ফেরাতেই হবে।

লেখক পরিচিতি:

মারুফ কামাল খান: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক।

 

ই-মেইল: [email protected]