
আল জাজিরা:
তেহরানের রাস্তাঘাট যেন অস্থিরতার গল্প বলছে—ফুটপাথ জুড়ে টানা হচ্ছে স্যুটকেস, একক মায়েরা এক হাতে সন্তান ধরে, অন্য হাতে কম্বল ও বালিশ নিয়ে নেমে যাচ্ছেন পাতাল রেল স্টেশনের দিকে—আরও এক রাত কাটবে মাটির নিচে। কোনো সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র নেই, নেই কোনো সতর্কবার্তা কিংবা পরিকল্পিত উদ্ধার তৎপরতা।
ইসরাইলি হামলার মুখে ইরানের তরুণ প্রজন্ম এখন একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আর চ্যাট অ্যাপগুলোর মধ্যে—যেমন ডিসকর্ড, হোয়াটসঅ্যাপ।
‘আমরা জানি না কোথায় যাব,’ বললেন ২৪ বছর বয়সি তেহরানের আইটি ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থী মোমো।
তিনি আরও বলেন, ‘তবুও আমি তেহরান ছাড়ছি না—আমার দুই বছরের বিড়ালটা ছাড়াও এটা আমার নীতিগত সিদ্ধান্ত। যাবই বা কোথায়? আমার বাসা এখানে, জীবন এখানে। আমরা দমন-পীড়নের কাছে কিংবা ইসরাইলি আগ্রাসনের কাছে হার মানব না। অনেকেই থেকে যাচ্ছে। জানি না কত দিন লাগবে, কিন্তু আমার বাড়িই যদি কবরে পরিণত হয়, তবু আমি বাস্তুচ্যুত হতে চাই না।’
ইন্টারনেটই এখন একমাত্র আশ্রয়
যখন আশ্রয়কেন্দ্র বা নিরাপদ স্থানের সুযোগ নেই, আর যোগাযোগ ব্যবস্থাও নজরদারিতে বা পুরোপুরি বন্ধ, তখন ইরানের জেনারেশন জেড—অর্থাৎ ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া তরুণরা—নতুন ডিজিটাল আশ্রয় তৈরি করছে নিজেদের মতো করে।
ডিসকর্ড ব্যবহার করছেন মোমো সাত বছর ধরে। ‘এটাই আমার শ্বাস নেওয়ার জায়গা,’ তিনি বলেন। ‘আগে গেম খেলার সময় বন্ধুদের সঙ্গে কেবল ভয়েস চ্যাটেই ব্যবহার করতাম। এখন এটা আমাদের ঘরের মতো হয়ে গেছে। আমরা অনেক সময় পরিবারের চেয়েও বেশি সময় কাটাই এই অনলাইন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। বোমাবর্ষণের মাঝেও একসঙ্গে সিনেমা দেখি, টিভি সিরিজ দেখি। কখনো কখনো অনলাইনে থেকেই ঘুমিয়ে যাই।’
এই প্রজন্ম বড় হয়েছে নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সেন্সরশিপের মধ্যে। ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর যে আন্দোলন শুরু হয়, ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ স্লোগান যার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তাতেও এই প্রজন্মের বড় ভূমিকা ছিল। তখন যেমন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ছিল অস্ত্র, এখনো ঠিক তেমনই।
ইরানি দৈনিক শারঘ’র তথ্যমতে, প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ইরানির—অর্থাৎ প্রায় ১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর—জেনারেশন জেড সদস্য যারা গেম খেলে এবং ডিসকর্ড ব্যবহার করে। নিষেধাজ্ঞা ও ব্লক থাকা সত্ত্বেও তারা ভিপিএন এবং এনক্রিপ্টেড অ্যাপের মাধ্যমে যুক্ত থাকছে।
২৩ বছর বয়সি সামিন বলেন, ‘হামলা শুরুর সময় আমরা একটা গেম খেলছিলাম। তখন বোঝা যাচ্ছিল না শব্দটা গেমের, নাকি বাস্তব। গেমে যেমন গুলি আর বিস্ফোরণ—ঠিক সেরকম শব্দ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বুঝতে পারি, এগুলো বাস্তব বোমার আওয়াজ।’
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইরানে ডিসকর্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকার দাবি করে, এতে ‘অশ্লীল কনটেন্ট’ ছিল, তবে অনেকে মনে করেন, সরকার এটা ব্যবহার করে প্রতিবাদের আয়োজন হচ্ছে বুঝে ব্যবস্থা নেয়।
‘ভিপিএন খুঁজে পেতে আমরা কত কিছুই না করি, শুধু ডিসকর্ডে লগইন করে আমাদের চ্যানেলে ঢোকার জন্য। কেউ অনলাইনে না এলে কল করি। কল চলাকালে হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে আমাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়—ভাবি, সে কি বোমায় মারা গেল?’ সামিন বলেন। ‘আমরা এখন আগের চেয়ে বেশি অনলাইনে থাকি, একে অপরের খবর নিই। জন্মদিন, বোমার শব্দ, প্রিয়জন হারানো—সব কিছুই এই অনলাইন দুনিয়ায় ভাগ করে নিই। এটা বেদনাদায়ক, কিন্তু এখানেই ভালোবাসা, আশাবাদ আর সংহতি খুঁজে পাই।’
গর্ভাবস্থা, আতঙ্ক, এবং দৃঢ়তা
এদিকে, তেহরানে গর্ভবতী নারীদের জন্য তৈরি একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ‘প্রি-নেটাল ইয়োগা’ এখন হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের এক অপ্রত্যাশিত কেন্দ্র।
গ্রুপে সদস্যদের কেউ কেউ গর্ভাবস্থায় শহর ছাড়তে পারেননি। তারা এখন একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করছেন শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার পরামর্শ, আর ব্ল্যাকআউটের সময় ভয়েস মেসেজ।
আমেনেহ ও তার বান্ধবী জোহরেহ, দুজনেই পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী। দুজনেই সন্তানসম্ভবা, তবে সিদ্ধান্ত ছিল আলাদা। জোহরেহ ফিরে এসেছিলেন ইরানে, পরিবারের সাহায্যে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য; আর আমেনেহ ছিলেন সানফ্রান্সিসকোতে, একা হলেও নিরাপদে সন্তানের জন্ম দিতে।
ইসরাইলি হামলার চতুর্থ দিনে তারা এখন যুক্ত আছে ‘যোগা ফর প্রেগনেন্সি’ নামে একটি গ্রুপ চ্যাটে।
‘আমরা একে অপরকে প্যানিক অ্যাটাক নিয়ন্ত্রণের উপায় শেখাই, একসঙ্গে যোগা করি, মোম জ্বালাই, ভয়েস নোট পাঠাই,’ বলেন আট মাসের গর্ভবতী জোহরেহ। “এক রাতে বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বন্ধুরা তখন আমাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিতে বলে, যাতে প্রসব বেদনা না ওঠে। আরেকবার, যখন বাচ্চার নড়াচড়া হচ্ছিল না, তখন তারা আমাকে বলল—সঙ্গীত চালাও, ম্যাসাজ করো, আবার যোগা করো।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন তেহরান ‘খালি করে দেওয়া’র হুমকি দেন, তখন গর্ভবতী নারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জোহরেহ বলেন, ‘তেহরান ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড জ্যাম আর সময়ের আগেই প্রসব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থেকে গেছি, যাতে হাসপাতালে পৌঁছানো যায়।’
পরিণতি
বোমা পড়ছে, অনিশ্চয়তা বাড়ছে, কিন্তু ইরানিরা এখনো ধরে রেখেছে একে অপরকে—ডিজিটাল স্পেসে, নীরবে, কিন্তু সাহসে ভরপুর। আকাশ যখন কোনো সতর্কতা দেয় না, সরকার যখন কোনো আশ্রয় দেয় না, তখনও তারা একে অপরকে খুঁজে নেয়—আলোহীন অন্ধকারে একা পড়ে না কেউ।
এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত নামগুলো গোপনীয়তার স্বার্থে পরিবর্তন করা হয়েছে। অনুবাদ : যুগান্তর