Image description

Muhammad Miraj Mia 


আজ ইরানের পার্লামেন্ট তাদের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে বৈশ্বিক জ্বালানির ধমনী হিসেবে পরিচিত হরমুজ প্রণালী বন্ধের অনুমোদন দিয়েছে।

এখন এই সিদ্ধান্ত তেহরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখবেন যে, পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করার একমাত্র সমুদ্রপথ এই হরমুজ প্রণালী। ইরান ও ওমানের ঠিক মাঝখানে প্রণালীটির অবস্থান। ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি প্রণালী।

মাত্র ৩৯ কিলোমিটার প্রশস্ত এই প্রণালি দিয়েই প্রতিদিন বিশ্বের মোট ব্যবহারের ২০ শতাংশ তেল পরিবাহিত হয়। পরিমাপের দিক থেকে প্রায় ২ কোটি ব্যসমপরিমাণ তেল। সাথে এক-পঞ্চমাংশ প্রাকৃতিক তরল গ্যাস, যা মূলত উপসাগরীয় দেশ কাতার থেকে আসে।

এই প্রণালী এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এর বিকল্প কোন পথ তেমন নেই। উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ তেল সরাসরি অন্য পথে পাঠানো যায় না। কাতার ও সৌদি আরবের কিছু বিকল্প রুট থাকলেও সেখানে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ তেল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

এটিই একমাত্র গভীর পানির রুট যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল ট্যাংকারও চলতে পারে।তাছাড়া, পারস্য উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চলটি বাণিজ্যিক ও সামরিক উভয় দিক থেকেই কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং ইরানের মতো প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের উৎপাদিত জ্বালানি এই পথ দিয়েই রপ্তানি করে।

এখন ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধের অনুমোদনের দেয় তাহলে খুবই অল্প সমের মধ্যে তেলের দাম দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ হয়ে যেতে পারে। যার প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী শিল্প উৎপাদনে, খাদ্যের দামে, পরিবহন খরচে, বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতিতে। তাই হরমুজ বন্ধ করা মানে এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্থবিরতা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে হরমুজ প্রণালী দিয়ে প্রবাহিত এই তেলের শতকরা ৮৪ ভাগ যায় এশিয়ায়। এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের জ্বালানির সিংহভাগের জন্য এই প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল। তাদের অর্থনীতি ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি গ্লোবাল সাউথ এর উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও বেশি জটিলতায় পড়বে।

কারণ বাংলাদেশ তার মোট জ্বালানির ৯০ শতাংশের বেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীল, যার একটি বড় অংশ আবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে। এমতাবস্থায় হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

ডলারের ওপর চাপ তৈরি করবে ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তীব্র হবে। ফলে মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় আরও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাবে।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হলে এদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও বাড়বে, যা সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ সংকটের সৃষ্টি করবে। খাদ্য পরিবহন এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি-রপ্তানির খরচ বাড়বে, যা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।

তবে প্রণালিটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া ইরানের জন্যও একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হবে, কারণ এতে তাদের নিজস্ব অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতি তেল নির্ভর হওয়ায় প্রণালী বন্ধ থাকলে তাদের বাজেটে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয়। ফলে উপসাগরীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোটভুক্ত হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। প্রণালী বন্ধ করার চেষ্টা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশ সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারে। ইরানের উপর নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।

তাছাড়া, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে তেহরানের মিত্র চীন তাদের অর্ধেক তেল এই রুট দিয়ে নেয়। হরমুজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে চীনের অর্থনীতিতেও বিপর্যয় আসবে।

তাই ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পরিষদ কী সিদ্ধান্ত নিবে সময়ই বলে দিবে। তবে এরই মধ্যে হরমুজ প্রণালীতে জিপিএস বিভ্রাটের কারণে প্রায় ৯৭০টি জাহাজ পথ হারিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বলা হচ্ছে এই বিভ্রাটের পেছনে ইরানই কলকাঠি নাড়ছে।

আমার ধারণা উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় ইরান হরমুজ প্রণালী সম্পূর্ণ বন্ধের দিকে যাবে না। স্বল্প পরিসরে বন্ধ রেখে রেখে একটা কূটনীতিক প্রেশার ক্রিয়েট করতে চাইবে তেহরান।

মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া,
লেখক- দি এ্যানাটমি অব ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স, দি কসমিক প্লে অব কন্টেমপোরারি গ্লোবাল পলিটিক্স।