Image description

এই প্রথমবার পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে হোয়াইট হাউসে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে মধ্যাহ্নভোজসহ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করলেন কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নয়, বরং সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ট্রাম্প। তার ভরপুর প্রশংসাও করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

এই ঘটনার পর বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কূটনীতি কি ভারতকে বিপাকে ফেলেছে? 

সেই বৈঠকের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দাবি খণ্ডন করে ট্রাম্প বলেছেন, আমি পাকিস্তানকে ভালোবাসি। আমি মনে করি, মোদি দারুণ একজন মানুষ। গতরাতে আমি তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। আমরা মোদি বা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে চলেছি। আমিই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছি। এই মানুষটি (আসিম মুনির) সংঘাত থামানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দিক থেকে খুবই প্রভাবশালী, মোদি এবং অন্যরা যেমন ছিলেন ভারতের দিক থেকে। দুই দেশই পরমাণু-শক্তিধর দেশ। আমিই তাদের থামিয়েছি। এর জন্য আমি কোনো গল্প বানাইনি।

এর আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিস্রি দাবি করেছিলেন, ট্রাম্পকে ফোনে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, পাকিস্তানের তরফে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, তারপর আলোচনা ও সংঘর্ষবিরতি হয়। ভারত পাকিস্তান ও কাশ্মীর নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্থতা মানেনি, মানবেও না।

প্রথমে ভারতের ওপর শুল্ক বসানো এবং শুল্ক কমানো নিয়ে ভারতের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করা, তারপর বারবার এই দাবি করা হয়, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত তিনিই থামিয়েছেন এবং শেষে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে আমন্ত্রণ করে আলোচনা করেছেন ট্রাম্প। তারপর স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, বন্ধু ট্রাম্পকে নিয়েও কি মনোভাব বদল করবেন প্রধানমন্ত্রী মোদি? ট্রাম্পের কূটনীতি কি ভারতকে বিপাকে ফেলেছে? ট্রাম্পের কূটনীতির মোকাবিলায় ভারতকেও কি কৌশল বদল করতে হবে?

ট্রাম্প জানেন পাকিস্তানে সেনাপ্রধানই আসল

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান লেফটোন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলে’কে বলেছেন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের কাছে সবচেয়ে অপমানজনক। ট্রাম্প চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, ভারতের বস যেমন প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের বস তেমনি সেনাপ্রধান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সেখানে সেকেন্ড ইন কম্যান্ড। সে জন্য ট্রাম্প মুনিরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই বিষয়টি নিয়ে ভারতে এত সোরগোলের কোনো প্রয়োজন নেই।

সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল কতটা প্রভাব ফেলবে পাকিস্তানে?

তিনি মনে করেন, ট্রাম্প-মুনির আলোচনায় ভারত নয়, গুরুত্ব পেয়েছে ইরান' উৎপল ভট্টাচার্য বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে পাঁচ হাজার সেনা ও ৬০টি যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে। তারা নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতা দেখাচ্ছে। তারা দেখাচ্ছে, তাদের পিছনে সমর্থন আছে। পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশও তাদের সমর্থন করছে। আর এক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক অপরিসীম গুরুত্ব আছে।

স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ ব্রক্ষ্ণ চেলানি ইন্ডিয়া টুডে-কে বলেছেন, ট্রাম্পের বার্তা হলো তিনি নিজের মতো চলবেন। ভারতকে এখন তাদের কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। ট্রাম্প যা করছেন পাকিস্তান নিয়ে, সেটা জো বাইডেনও করেছেন। আইএমএফ থেকে পাকিস্তানকে ঋণ পাইয়ে দিয়েছেন, এফ ১৬ যুদ্ধবিমান দিয়েছেন। বাইডেন যেখানে ছেড়েছিলেন, সেখান থেকে ট্রাম্প ধরেছেন। 

উৎপল ভট্টাচার্য বলেছেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা বরাবর পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এখন ট্রাম্পের মতো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টও তাদের সঙ্গে আছেন।

ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার বিরোধিতা করেনি। ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনেছে। রাশিয়া হলো ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু। ফলে ভারত নিজেদের স্বার্থ দেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রও তাদের স্বার্থ দেখবে। তবে ভারতকেও সেইমতো প্রস্তুত থাকতে হবে এবং বাস্তবতার কথা মাথায় রাখতে হবে।

কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশেষজ্ঞ অ্যাশলি জে টেলিস এনডিটিভিকে বলেছেন, আমার মতে মুনিরকে ডাকা ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। নিজের প্রশাসনে এনিয়ে মতৈক্য ছিল বলে মনে হয় না ট্রাম্প নিজেকে পিসমেকার বলে মনে করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে খুব বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ফিল্ড মার্শাল মুনিরের সঙ্গে লাঞ্চ সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে।'

অ্যাশলি মনে করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথাতেও যুক্তি আছে। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোমেসি করেছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বড় ভূমিকা পালন করেছেন। আমি মনে করি, ট্রাম্প অতিশয়োক্তি করেছেন। ট্রাম্পকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, কিন্তু তিনি যা বলছেন, সেটাকেই হুবহু মানার দরকার নেই।

ভারত কেন উদ্বিগ্ন হবে?

উৎপল ভট্টাচার্যর মতে, ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হলো, ইরান নিয়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে কতটা সাহায্য করতে পারে? পাকিস্তানও তো একটা মুসলিম দেশ। তারা ইরান সীমান্ত সিল করে দিয়েছে, তার বেশি কিছু করতে পারে বলে মনে হয় না। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক কারণে বরাবরই ভালো সম্পর্ক ছিল, এখনো থাকবে। তাতে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।

তবে উৎপল ভট্টাচার্য় মনে করেন, ট্রাম্প বারবার বলছেন, তিনিই ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত মিটিয়েছেন। আর ভারতের তরফে অনেক দেরিতে তার জবাব দিচ্ছেন পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিস্রি। আমরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করব। কিন্তু গোটা বিশ্বের কাছে তো ট্রাম্পের বার্তাটাই অনেক আগে পৌঁছে গেছে। এটা ভেবে দেখা দরকার।