
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রায়ই এমন ঘটনা সৃষ্টি করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ঢেকে দেওয়া। যেমন—একটি মিথ্যা চাপা দিতে আরেকটি মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়, ঠিক তেমনি একটি অন্যায় আড়াল করতে গিয়েই আরেকটি নতুন অন্যায় করা হয়। এইভাবে মিথ্যার বন্যা যেমন সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি তৈরি হয় অন্যায়ের স্তূপ।
ইরানে ইসরায়েলের হামলা এবং গাজায় সংঘটিত গণহত্যার মধ্যেও তেমনি এক গভীর রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে। তাই ইরান আক্রমণের প্রসঙ্গ কখনোই গাজার প্রসঙ্গকে বাদ দিয়ে আলোচনা করার সুযোগ নেই। গাজায় গণহত্যা ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্ন উপেক্ষা করে আলাদা করে ইরান ইস্যু নিয়ে কথা বলা মূলত জায়োনিস্ট পরিকল্পনার ফাঁদে পা দেওয়া।
মাত্র ২৪ ঘণ্টা যেতেই গুলি, বোমা ও ড্রোন হামলা চালিয়ে ইসরায়েলি সৈন্যরা গাজায় ১৪০ জন মানুষকে হত্যা করেছে। আর গত ২০ মাসে ইসরায়েলের আগ্রাসনে গাজায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত, লক্ষাধিক মানুষ আহত, বহু স্কুল, হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টির সামনে একটি জেনোসাইড ঘটিয়ে চলেছে জায়োনিস্ট রাষ্ট্রটি।
ইসরায়েলের আগ্রাসন শুধু ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি সম্প্রসারিত হয়েছে লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ পুরো অঞ্চলে। সম্প্রতি ইরানে চালানো হামলা এই আগ্রাসনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। আর এই সবকিছুই তারা করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন এবং ইউরোপের সহযোগিতায়।
ইসরায়েল এখন এক ভয়ঙ্কর, দানবীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে—যার মধ্যে মানবিকতা বা ন্যূনতম নৈতিকতার ছাপও খুঁজে পাওয়া যায় না। পারমাণবিক বোমা তৈরির মিথ্যা অজুহাত তুলে বিনা প্ররোচনায় ইরানে হামলা চালিয়ে তেহরানকে পুড়িয়ে ফেলা, সরকারের পতনের চেষ্টা, ইত্যাদি ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ এক স্বেচ্ছাচারী শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। এই ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের ফলে অনেকেই ইসরায়েলকে এখন ‘মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার’ বলেও অভিহিত করছেন।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রায় চার দশক ধরে ইরান আক্রমণের স্বপ্ন লালন করে এলেও গত ১৩ জুন ইরান আক্রমণটি এক রহস্যজনক সময়েই সংঘটিত হয়—যখন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড নিশ্চিত করেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না। সর্বোপরি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক চুক্তি নবায়নের আলোচনা চলছিল তখন।
এই আক্রমণের কারণ আসলে জটিল নয়, বরং অনেক সরল। রয়টার্সের ১৯ জুনের প্রতিবেদনে গাজার অধিবাসী আদেল বলছিলেন, “দিনরাত মানুষকে গলা কেটে হত্যা করা হচ্ছে গাজায়, কিন্তু আন্তর্জাতিক মনোযোগ এখন সরে গেছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের দিকে। গাজার খবর এখন খুব সামান্যই প্রচার হচ্ছে।”

উত্তর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত ফিলিস্তিনিদের জানাজায় শোকাহত মানুষের প্রতিক্রিয়া। তারা সাহায্য সংগ্রহের সময় হামলার শিকার হন। ১৮ জুন গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালে। ছবি: রয়টার্স
ইসরায়েলি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফোরাম ফর রিজিওনাল থিংকিং’-এর সঙ্গে যুক্ত ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওরি গোল্ডবার্গ মিডল ইস্ট আই-কে (১৩ জুন ২০২৫) বলেন, “আসল লক্ষ্য হলো গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া। গাজায় চলছে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, আর পশ্চিম তীর পুরোপুরি অধিকৃত।”
১৫ জুন আল জাজিরায় প্রকাশিত ‘দ্য রিয়েল রিজন ইসরায়েল অ্যাটাকড ইরান’ শীর্ষক প্রবন্ধে গোল্ডবার্গ আরও লিখেছেন, “সন্দেহ নেই নেতানিয়াহু বহু বছর ধরে ইরান আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। এখন এই হামলার মাধ্যমে তিনি বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলের দায়মুক্তির বিরুদ্ধে গৃহীত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপগুলো ঠেকাতে বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।”
প্রথমে এ আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও পরে ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করেন, এই অভিযান ছিল যৌথ। অথচ ট্রাম্প নিজেকে পরিচয় দেন ‘চুক্তি নির্মাতা’ ও ‘শান্তির দূত’ হিসেবে। বাস্তবে, তিনি হয়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুক্তিভঙ্গকারী এবং যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সম্মানিত ইহুদি বংশোদ্ভূত মার্কিন রাজনীতিক বার্নি স্যান্ডার্স এক ভিডিও বার্তায় ট্রাম্পের এই দ্বিচারিতা এবং যুদ্ধ উসকে দেওয়ার ভূমিকা কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন। ১৯ জুন প্রকাশিত ভিডিওটিতে তিনি বলেন, “২০২৫ সালে মানুষ চেয়েছিল আমরা জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য, মহামারির ঝুঁকি কমানো নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হব। কিন্তু তার বদলে আমরা জড়াচ্ছি আরেকটি অন্যায় যুদ্ধে।”
বার্নি স্যান্ডার্স ট্রাম্পের এই দ্বিচারিতার কথাটি উল্লেখ করেছেন তার এক্স হ্যান্ডলে প্রকাশিত ভিডিওতে। তিনি বলেছেন, “২০২৫ সালে পৃথিবীর মানুষ আশা করেছে আমরা অস্তিত্বের হুমকি যে বৈশ্বিক উষ্ণতা তা হ্রাস, ভবিষ্যতের মহামারি প্রতিরোধ, বিরাট আয় বৈষম্য দূরীকরণ, শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো ইত্যাদির জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। কিন্তু তা হলো না, হচ্ছে উল্টোটো।”
ভিডিওতে তিনি বলেছেন, নেতানিয়াহুর প্ররোচণায় ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে জড়াচ্ছে, যা আসলে ইরানের ওপর ইসরায়েলের আক্রমণ। আর এই নেতানিয়াহুটা কে? মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি: গাজায় হত্যা ও দুর্ভিক্ষের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গগুলো তুলে এনেছেন স্যান্ডার্স যাকে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন না দেওয়ার জন্য ও যাকে ঠেকানোর জন্যই দুর্নীতিপরায়ণ ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব একবার হিলারিকে ও পরেরবার বাইডেনকে মনোনয়ন দেয়। আর এভাবেই মূলত ট্রাম্পের ক্ষমতায় আরোহনকে ডেমোক্র্যাটরা সম্ভব করে তোলে। রিপাবলিক্যান জাতিবিদ্বেষী (রেসিস্ট) প্রার্থী ট্রাম্পকে ঠেকানোর চেয়ে তাদের সমস্ত শক্তি ব্যয় হয়েছিল বার্নির মনোয়ন প্রতিরোধে। সে কাজে তারা সফল হয়েছে দুবারই ট্রাম্পের কাছে গোহারা হেরে।
সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ট্রাম্পের সহযোগিতায় নেতানিয়াহু এই ইরান আক্রমণের মধ্য দিয়ে কীভাবে বিশ্ব মনোযোগকে গাজার গণহত্যা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। একজন আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ইরানের দোষের তালিকা তৈরি করে তার নিরীহ জনগণকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন সমস্ত আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। ১৪ জুন গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এমা গ্রাহাম-হ্যারিসনের লেখায় (‘স্ট্রাইকস অন ইরান ইজ প্রেশার অন ইসরায়েল টু এন্ড স্টারভেশন ইন গাজা’) বিষয়টি আরও বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে। তিনি শুরু করেছেন এভাবে: “ইরানে ইসরায়েলি হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গাজায় খাদ্য সরবরাহ ও বিতরণ থেমে গেল এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বৈশ্বিক স্বীকৃতি লাভের জন্য একটি ফ্রেঞ্চ-সৌদি শীর্ষ সম্মেলনের উদ্যোগ ভেস্তে গেল। প্রথম মিসাইল আক্রমণের ধোঁয়া তেহরানের আকাশ থেকে মিলিয়ে যেতে না যেতেই গাজায় দুর্ভিক্ষ ও নিরীহ মানুষ হত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ নেই হয়ে গেল।”
ফ্রেঞ্চ-সৌদি সম্মেলনে দ্বিরাষ্ট্রের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সম্ভাবনাটি অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। এটা ইসরায়েল ও তার মিত্রদেরকে এতটা আতঙ্কিত করে যে, ওয়াশিংটন থেকে এখানে কারো যোগদানের ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া হয়। এর ফলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যা গাজায় হত্যা বন্ধ করতে পারত তা শেষ হয়ে গেছে। যেসব সরকার যারা নেতানিয়াহুর গাজায় হামলার সমালোচক হয়ে উঠেছিল তারাও এখন হামলা বন্ধে অনিচ্ছুক হবে যখন কিনা তেহরানের মিসাইল তেল আবিবে মানুষ মারছে। ফ্রান্সের এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বক্তব্য, ইরানে আক্রমণ যেন আমাদেরকে গাজার কথা ভুলিয়ে না দেয়। তিনিও এখন সৌদির সঙ্গে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করছেন না, সহজেই গাজার কথা আর মনে পড়ছে না তার।
এমা গ্রাহাম-হ্যারিসন আরও উদ্ধৃত করেন, আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরিফের এক্সে প্রকাশিত কথায়—“দুর্ভিক্ষ আরও ভয়াবহ হচ্ছে, দখল আরও বিস্তৃত হচ্ছে, মৃতদেহ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে; আর গাজা হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর চোখের আড়ালে।”
সুতরাং এটি স্পষ্ট—ইরানে শুরু করা নতুন যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে গাজার গণহত্যাকে আড়াল করার এক ঠান্ডা, কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়েছেন ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু। নতুন যুদ্ধের আগুন দিয়ে আগের যুদ্ধের ছাই ঢেকে দেওয়ার এই জায়োনিস্ট রাজনীতির কাছে ফ্যাসিবাদও যেন তুচ্ছ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমা গ্রাহাম-হ্যারিসন লিখেছেন– আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ এক্স পোস্টে বলেছেন, “দুর্ভিক্ষ আরও তীব্র্র হচ্ছে, দখল আরও বিস্তৃত হচ্ছে এবং মৃতরা ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে” আর গাজা “হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর চোখের আড়ালে।”
অতএব, এ হচ্ছে ইরানে নতুন শুরু করা হত্যাযজ্ঞ দিয়ে গাজার গণহত্যা ঢাকবার নেতানিয়াহু-ট্রাম্প যৌথ স্ট্র্যাটেজি। নতুন গণহত্যা শুরুর প্লট তৈরি করে পূর্বের গণহত্যা ঢাকবার এই জায়োনিস্ট রাজনীতির কাছে ফ্যাসিজম কতই না তুচ্ছ!