
ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা যখন চরমে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একদিকে কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে বক্তব্য দিলেও, অন্যদিকে সামরিক হুমকি ও সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছেন—যা সংঘাতের জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
কূটনীতি না কি চাপ প্রয়োগ?
গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প Truth Social-এ পোস্ট দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা এখনো কূটনৈতিক সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” তবে মাত্র ১৪ ঘণ্টা পর, ইসরাইল যখন ইরানে হামলা চালায়, তখন ট্রাম্প জানান, তিনি আগেই ইরানকে ৬০ দিনের সময়সীমা দিয়েছিলেন—যার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
রবিবার ট্রাম্প বলেন, “ইসরাইল ও ইরানকে চুক্তি করতে হবে, এবং তা আমার মাধ্যমে হবে।” সোমবার, কানাডায় অনুষ্ঠিত G7 সম্মেলন থেকে তড়িঘড়ি করে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার সময় তিনি বলেন, “ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র পাবে না,” এবং সতর্ক করে দেন, “তেহরান থেকে সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নেওয়া উচিত!”
মার্কিন জড়িত থাকার বিষয়ে ধোঁয়াশা
ট্রাম্প দাবি করেছেন, “ইরানে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, তাঁর বক্তব্য ও সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো অন্য ইঙ্গিত দেয়।
আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক কেলসি ড্যাভেনপোর্ট বলেন, “ট্রাম্প সামরিক পদক্ষেপের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ঠিকই, তবে ইসরাইল কূটনৈতিক প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার আগেই হামলা চালিয়েছে—যাতে চুক্তি না হয়।”
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা রিচার্ড নেফিউ বলেন, “ট্রাম্প ধারাবাহিকভাবে চুক্তির পথে এগোচ্ছিলেন—এটাই ইসরাইলের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।”
স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি আনসারি বলেন,“যুক্তরাষ্ট্র সময় সম্পর্কে হয়তো অজ্ঞ ছিল, কিন্তু হামলার ব্যাপারে যে তারা জানত না—এমনটা বলা যায় না। এটা ছিল এক ধরনের 'চোখ টেপা সম্মতি'।”
যুক্তরাষ্ট্র কি সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে?
ইসরাইল দাবি করেছে, তারা ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনার ওপরে অংশ ধ্বংস করেছে, যেখানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হতো। তবে আইএইএ জানিয়েছে, ইরানের আরেক গোপন কেন্দ্র ফোর্ডোর কোনও ক্ষতি হয়নি।
ড্যাভেনপোর্ট বলেন, “নাতাঞ্জের নিচের অংশ কিংবা ফোর্ডোর মতো ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় আঘাত হানতে হলে ইসরায়েলকে মার্কিন সহায়তা দরকার হবে—বিশেষ করে ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের 'Massive Ordnance Penetrator' বোমার মতো অস্ত্র, যা এখনও ইসরায়েলের কাছে নেই।”
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা বেড়েছে
শুক্রবার মার্কিন বিমানবাহিনী বড় সংখ্যক জ্বালানি-সরবরাহকারী বিমান মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়েছে। ইউএসএস নিমিটজ বিমানবাহী রণতরী অঞ্চলটিতে মোতায়েন হয়েছে এবং নতুন করে যুদ্ধবিমান পাঠানোর ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্পের যুদ্ধ-আকর্ষণ?
নেফিউ বলেন, “ট্রাম্প বিজয়ীদের পাশে থাকতে পছন্দ করেন। এখন তিনি ইসরায়েলকে বিজয়ী মনে করছেন বলেই সরাসরি সমর্থন দিচ্ছেন।”
আনসারি মনে করেন, “ট্রাম্প অংশগ্রহণ করতে পারেন কেবল কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য। তবে এমন হস্তক্ষেপ ইরানকে আলোচনায় টেনে আনতে পারে।”
তাঁর মতে, “যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের পক্ষ থেকে সম্মানজনকভাবে চুক্তি করা সম্ভব হলেও, ইসরাইলের সঙ্গে এমনটা কঠিন।”
যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়া
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন সিনেটর টিম কেইন কংগ্রেসে একটি War Powers Resolution উত্থাপন করেছেন, যার মাধ্যমে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া ইরানে কোনো সামরিক অভিযান চালানো যাবে না।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একান্ত প্রয়োজন না হলে, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী।”
কূটনীতির পতন ও পারমাণবিক উদ্বেগ
২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামার নেতৃত্বে স্বাক্ষরিত Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA) চুক্তি ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের একটি কূটনৈতিক পথ। কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে সরে আসেন, যার ফলে ইরান ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে ২০২৩ সালে ৮৩.৭ শতাংশে পৌঁছে দেয়।
নেফিউ বলেন, “চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ফলে আমরা আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছি। এটা দেশগুলোর কাছে এমন বার্তা দেয়: নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক অস্ত্রই একমাত্র পথ।”
পরিস্থিতি অশনি সংকেত দিচ্ছে
ড্যাভেনপোর্ট সতর্ক করে বলেন, “ইরানে সরকার পরিবর্তন হলেও, সেটা পারমাণবিক হুমকি কমাবে—এমন নিশ্চয়তা নেই। সামরিক বাহিনীর দখলে গেলে বিপদ আরও বাড়তে পারে।”
সূত্র: আলজাজিরা