
গত শুক্রবার ভোরে ইসরায়েলের অতর্কিত ভয়াবহ হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় ২০ সেনা কমান্ডার শহীদ হয়েছেন। গোটা ইরান যেন থমকে পড়েছিল। চারদিকে পিনপতন শব্দও নেই। বিস্ময়ের যেন শেষ ছিল না। একসঙ্গে এত বড় বিপর্যয়!
ভোরের আলো ফুটল বটে, কিন্তু দিনের আলো যেন হামলার তীব্রতায় ম্লান হয়ে থাকল। ধীরে ধীরে বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে ইরানের পক্ষ থেকে বক্তব্য আসতে শুরু হলো। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক জবাবের। দিনভর কঠোর কঠিন প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা শেষে ওইদিন রাত সাড়ে ১০টা থেকে ইরান পাল্টা প্রতিশোধমূলক তীব্র হামলা শুরু করে।
তার পর থেকে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। দিনের আলোতেও তেহরানসহ গোটা ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে থেমে থেমে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
ক্ষণে ক্ষণে তেহরানে বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে চারদিকে। রাত-দিনের তফাত নেই।
জনমনে যুদ্ধের প্রভাব
ইরানিদের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা ও উদ্বেগ থাকলেও ভয় কিংবা শঙ্কা দেখছি না। যুদ্ধ যেন ইরানিদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। হ্যাঁ, গা-সওয়া তো বটেই। এর আগে ইরাকের সঙ্গে আট বছরের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ইরান কঠোরভাবে মোকাবেলা করেছে এবং জয়ী হয়েছে। তার পেছনে ছিল আমেরিকার হাত। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভ করার সময় থেকেই, অর্থাৎ ৪৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা ইরানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা, হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে। আর সেসব মোকাবেলা করে ইরান তার জাতীয়, অর্থনীতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে। বিশেষ করে সামরিক খাতে তাদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। যার ফল দেখা যাচ্ছে ইসরায়েলি হামলার পাল্টাহামলায় শত শত ড্রোন, ক্রুজ, ব্যালিস্টিক ও সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে অনেকটা কোণঠাসা করেছে। ফলে যে কথা বলছিলাম, যুদ্ধ যেন আর্য ইরানি জাতির কাছে ডাল-ভাতের মতো।
তার পরও তো যুদ্ধ! যুদ্ধ মানে রক্ত ঝরানো, প্রাণের বিসর্জন আর বহুবিধ ক্ষতির ক্ষেত্র তৈরি করা। সেই যুদ্ধ এখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলছে। ইরানিদের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিছু মতপার্থক্য থাকলেও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে গোটা ইরানি জাতি একাট্টা—এমন মনোভাব আমি গত ২১ বছরের ইরান প্রবাস জীবনে দেখেছি। আর সে জন্য এই যুদ্ধ নিয়ে সেভাবে উদ্বেগ দেখাচ্ছে না ইরানিরা।
যেমন দেখছি তেহরানে
রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা। যানবাহন তুলনামূলকভাবে বেশ কম। অফিস-আদালতে উপস্থিতি কম এ জন্য যে বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে অফিসপাড়ায় যুদ্ধ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। একজন ইরানির সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, গত রাতে তো ব্যাপক হামলা হয়েছে, বিস্ফোরণের শব্দে ঘুমাতে পারিনি। কখনো বাসার ছাদে, কখনো বারান্দায় গিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। তোমার কি ঘুম হয়েছিল? তিনি বেশ দার্শনিক একটা উত্তর দিলেন। বললেন, অনেক ভালো ঘুম হয়েছে। বললাম, কিভাবে! তিনি বললেন, ‘আমি এই জন্য ঘুমিয়েছি যে আমার তো করার কিছু নেই। যা করার করবে সরকার এবং আমাদের সেনাবাহিনী। তাই আমি ঘুমিয়েছি।’ ভাবলাম, ঠিকই তো বলেছেন তিনি। এ রকম ভাবনা আমি বেশির ভাগ ইরানির মধ্যে দেখি।
তবে ভিন্ন চিত্রও আছে। তেহরানে ইসরায়েলি হামলার ব্যাপকতায় রাজধানী থেকে অনেক মানুষ ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছে। এমনকি অনেক বিদেশিও তেহরান ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। বিভিন্ন দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের দেশের নাগরিকদের তেহরান ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যারা দেশে যেতে চায়, সড়কপথে তারা এক্সিট ভিসা ছাড়াই যেতে পারবে বলে জানানো হয়েছে। তবে সবাই তেহরান ছেড়ে যেতেও পারছে না নানা কারণে।
বিশেষ সতর্কতা হিসেবে হামলার সময় অনেককে পার্কে গিয়ে থাকতে দেখা গেছে। কাউকে কাউকে মেট্রো স্টেশনের ভূর্গভস্থ স্থানে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। সর্বশেষ নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প তেহরান খালি করার যে হুমকি দিয়েছেন, তাতে তো সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোরই কথা! এই হুমকিতে তাই আগেই বলেছি, অনেকে তেহরান ছেড়ে পরিবার-পরিজনসহ দূরে কোনো নিরাপদ জায়গার উদ্দেশে যাত্রা করেছে। কেউ বা করবে, আবার অনেকে পৌঁছে গেছে।
বাংলাদেশিরা কেমন আছে
ইরান একটি বিশাল দেশ। ব্যাপক অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার বাংলাদেশি আছে। এর মধ্যে তেহরানে আছে হাজারখানেক। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাস বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এর আগেও সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশিদের উদ্দেশে। তারা সব রকম সহযোগিতা করার কথা বলেছে। তবে তেহরানে বাংলাদেশ দূতাবাসও ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে জেনেছি এবং নিরাপদ স্থানে দূতাবাসের সবাইকে সরিয়ে নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে দূতাবাসের সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইরানে বসবাসরত সব বাংলাদেশি নাগরিকের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য দূতাবাস ইমার্জেন্সি হটলাইন স্থাপন করেছে। ইরানে বসবাসরত সব বাংলাদেশি নাগরিক নিচের মোবাইল ফোন নম্বরগুলোতে (হোয়াটসঅ্যাপসহ) সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে। মোবাইল নম্বর : +৯৮ ৯৯০৮৫৭৭৩৬৮, +৯৮ ৯১২২০৬৫৭৪৫।
ইরানের যুদ্ধকৌশল
ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) সিনিয়র কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহসেন রেজায়ি বলেছেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হবে। তবে ইরান তার গোপন সামরিক শক্তি ব্যবহার করে বিজয়ী হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বলেছেন, ইরানের সেনাবাহিনী পূর্ণ প্রস্তুতির সঙ্গে ইসরায়েলের ওপর কঠোর আঘাত হানতে থাকবে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. পেজেশকিয়ান ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইরানই এই গল্পের শেষ অধ্যায় লিখবে। বোকামিপূর্ণ কাজের জন্য ইসরায়েলকে অনুতপ্ত হতে হবে।
আর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি বলেছেন, ইহুদিবাদী ইসরায়েল বড় ভুল করে ফেলেছে, মারাত্মক ভুল করেছে এবং এর পরিণতিতে (দখলদার ইসরায়েল) অসহায় হয়ে পড়বে, ইনশাআল্লাহ। তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে ইরান ইসরায়েলি হামলার কঠোর প্রতিশোধমূলক হামলা ট্রু প্রমিজ থ্রি অব্যাহত রাখবে এবং যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হবে।
দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আশঙ্কায় ইসরায়েল উদ্বেগে
এদিকে ইরানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আশঙ্কায় ইহুদিবাদী ইসরায়েল খুবই উদ্বেগে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ওয়ালা নিউজের ইহুদিবাদী বিশ্লেষক ডেনিস স্ট্রানোভিচ। তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন : যুদ্ধ চলছে, কিন্তু ইসরায়েলের আশঙ্কা হলো, এটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। এমনটি হলে তা ইসরায়েলের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে। স্ট্রানোভিচ আরো বলেছেন, যদি যুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলে, তাহলে তা ইসরায়েলি অর্থনীতি ও সমাজ ভেঙে ফেলবে। দখলদার ইসরায়েলের জায়নিস্ট সেন্টার ফর সিকিউরিটি রিসার্চের গবেষক এবং সামরিক গোয়েন্দা পরিষেবার ইরানবিষয়ক ডেস্কের সাবেক এই প্রধান বলেন, ইসরায়েলকে এটা বুঝতে হবে যে ইরানের পরমাণু বা ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার ক্ষমতা তাদের নেই এবং দ্রুত ইরানের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ শেষ করতে হবে। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতেও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা যুদ্ধ শেষ করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছেন না; তাঁরা বিভ্রান্তিতে রয়েছেন।
কেন এই যুদ্ধ
ইসরায়েল বলেছে, তারা ইরানে হামলা চালিয়েছে প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি হিসেবে। কিসের প্রতিরোধ! ইরান পরমাণু সমৃদ্ধকরণে অনেক এগিয়ে গেছে, যেকোনো সময় পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারে—এই ভয়। আর ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করলে ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি!
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে না সে কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন। ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলো আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নজরদারিতে রয়েছে। শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু ব্যবহারের উপযোগিতা থেকে এর আগেও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে চুক্তি হয়। সেই চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর আগের শাসনামলে একতরফাভাবে বেরিয়ে আসেন। নতুন করে এবার ক্ষমতায় আসার পর আবারও তা নিয়ে পাঁচ দফা আলোচনা চলেছে। গত রবিবার ষষ্ঠ দফা আলোচনার কথা ছিল। তার আগেই ইসরায়েল ইরানে অতর্কিতভাবে ভয়াবহ আগ্রাসন চালাল।
শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলের হাতে শত শত পরমাণু বোমার ওয়ারহেড আছে। তারা প্রায় দুই বছর ধরে দিনের আলোতে অর্ধলক্ষেরও বেশি গাজাবাসীকে হত্যা করেছে। বিরানভূমিতে পরিণত করেছে গাজা নামক জনপদটিকে। একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।
পরমাণু অস্ত্র আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শত শত। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের কাছে ওই অস্ত্রটি আছে। এমনকি ভারত ও পাকিস্তানের কাছেও আছে। পৃথিবীতে একমাত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যারা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করেছে জাপানে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই; বিশ্বের কোনো আতঙ্ক নেই। অথচ ইরান পরমাণু অস্ত্র নয়, শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু কর্মসূচি পর্যন্ত চালাতে পারবে না! এটি নাকি ইসরায়েলের জন্য হুমকিস্বরূপ।
আর তাই ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এর চেয়ে বড় অবাক করা কথা আর কী হতে পারে! অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, তাঁদের কোনো হাত নেই এই হামলার ক্ষেত্রে। অথচ এ কথা অন্তত যাঁরা বিশ্বরাজনীতি বোঝেন তাঁদের সবার জানা—আমেরিকার অনুমতি ছাড়া ইসরায়েল যুদ্ধ দূরে থাক, ওয়াশরুমেও যেতে পারে না।
এ ধরনের ধোঁকাপূর্ণ কথা দিয়ে বিশ্ববাসীকে আসলে কী বোঝাতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! ইসরায়েল তার পেটোয়া বাহিনী হিসেবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তারা পশ্চিম এশিয়াকে।
এবার মনে হয় একটি পরিণতির সময় এসে গেছে। এই যুদ্ধ কোথায় নিয়ে যায়, তা দেখার জন্য কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও উপস্থাপক, রেডিও তেহরানের বাংলা অনুষ্ঠানে কর্মরত