
পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে ইসরাইল ও ইরানের সংঘাত। একটি পুরো মাত্রার যুদ্ধ বলতে যা বোঝায়, তার প্রায় সব উপাদান উপস্থিত। লক্ষণীয়, ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম’কে ভেদ করে দেশটিতে ভয়াবহ হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে ইরান। ফলে তছনছ হয়ে গেছে ইসরাইল। বহু ভবন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১৩ জন। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ইসরাইলের ভয়াবহ ক্ষতিতে শোকার্ত দেশ। খুব দুঃখজনক ও কঠিন সময় পার করছে ইসরাইল। ক্ষয়ক্ষতি কেমন হলে প্রেসিডেন্ট এমন মন্তব্য করতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। এমন অবস্থায় আশার বাণী শুনিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক ভারত ও পাকিস্তানের মতো সহসাই যুদ্ধ বন্ধ হবে। এই যুদ্ধে ইরানে ক্ষয়ক্ষতি অবর্ণনীয়। ইসরাইল দাবি করেছে তারা শনিবার রাতভর ইরানের ৮০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। তিনদিনে ইরানের কমপক্ষে ৭২০টি সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে। পাশাপাশি ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের প্রধান এবং সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের ও বিপুল সংখ্যক পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। সঙ্গে তো বেসামরিক স্থাপনা, প্রাণহানির খবর আছেই। এই ক্ষতির সঙ্গে ইসরাইলের ক্ষতি তেমন বড় নয়। কারণ তারা ইসরাইলের সামরিক বা প্রশাসনিক কোনো স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে এমন কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা ইসরাইলের বিধ্বস্ত ভবনগুলোর যে ছবি প্রকাশ করেছে তা ভয়াবহ। গত রাতে এ খবর লেখার সময়ও ইসরাইলের হামলায় তেহরানের আকাশ ছিল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে তেহরান। পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণ হয়েছে। ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস জানিয়েছে, ইরানে হামলা অব্যাহত আছে। ওদিকে পাল্টা জবাব দিচ্ছিল ইরানও। ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষায় অনেক মিডিয়া সেখানে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি প্রকাশ করছে না। তারপরও যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে, তাতে বলা হয়েছে বিপুল পরিমাণ আবাসিক ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলের কেন্দ্রস্থলে, তেল আবিবে হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে বহু মানুষ।
অন্যদিকে ইরানে তেলের ডিপো সহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন জ্বলছে। একইভাবে আগুন জ্বলতে দেখা যায় ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে। সেখানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছে। সেখানে স্থানীয়দের বিভিন্ন বাংকারে অবস্থান নিতে নির্দেশনা দিয়েছে ইসরাইল কর্তৃপক্ষ। লোকজন এমন গোপন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন এমন ছবি প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মিডিয়া। ইসরাইলের এই যে অবস্থা এমনটাও হওয়ার কথা ছিল বলে অনেকে মনে করেন না। কারণ, তাদের আছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম। তা ভেদ করে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছে বিভিন্ন ভবনে। ইসরাইল যতই বলুক তারা আকাশে ধ্বংস করে দিয়েছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র, তা যে পুরো সত্য এমন না।
ইসরাইলের ধ্বংসস্তূপ দেখে বলে দেয়া যায় ইরানের পাশাপাশি ইসরাইলও এখন তছনছ হয়ে গেছে। তবে যে কোনো সময় ‘তেহরানকে জ্বালিয়ে দেয়ার’ হুমকি দিচ্ছে ইসরাইল। ইরানও পাল্টা হুমকি দিচ্ছে। তবে তাদের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে দেশকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য সামরিক, পারমাণবিক ও রেভ্যুলুশনারি গার্ডের যেসব শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের শেষ করে দিয়েছে ইসরাইল। পারমাণবিক স্থাপনা, তেলক্ষেত্র বা তেলের ডিপোতে একের পর এক হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। জবাবে ইরান বলছে, ইসরাইল হামলা বন্ধ করলে ইরানও বিরত হবে। এ যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করছে তারা। মার্কিন প্রশাসন থেকে তা অস্বীকার করা হলেও বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট। অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের নীরব দর্শকের ভূমিকায় এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের মদতে ইসরাইল এই যুদ্ধ করছে। তাদের সমর্থনকারী বিশ্ব মোড়লরা আছেন। সেক্ষেত্রে দৃশ্যত একা লড়াই করছে ইরান। তাকে সমর্থন দেয়ার কেউ নেই। এমন সময়ে লড়াইয়ের তৃতীয় দিনে বন্ধু হিসেবে ইয়েমেনকে পাশে পেয়েছে ইরান। রোববার ইয়েমেন থেকে ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে।
একইসঙ্গে তেল আবিব থেকেও ইয়েমেনের যোদ্ধাগোষ্ঠী হুতিদের লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালানো হয়েছে। ইসরাইল জানিয়েছে, তাদের নিশানায় ছিলেন হুতিদের সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ মুহাম্মদ আল-ঘামারি। তবে তার কোনো ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এমন অবস্থায় একের পর এক হামলা-পাল্টা হামলায় জ্বলছে ইরান ও ইসরাইল। এর মধ্যে দৃশ্যত ক্ষয়ক্ষতি ইরানে বেশি। তবে ইসরাইলেও কম নয়। সেখানে কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে ৯ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধসে পড়া ভবনের নিচে আটকা পড়ে আছে অনেক মানুষ। তাদের পরিণতি জানা যায়নি। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদেরকে উদ্ধারের চেষ্টা করছিল ইসরাইলি উদ্ধারকর্মীরা।
শনিবার রাতে ইসরাইল ও ইরান উভয়েই হামলা-পাল্টা হামলা তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। সংঘর্ষে ইতিমধ্যেই বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এই যুদ্ধ শুধু দুটি দেশের দ্বন্দ্ব নয়- এটি গোটা মুসলিম বিশ্ব, পশ্চিমা শক্তি এবং বৈশ্বিক কূটনৈতিক কাঠামোর জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বনেতাদের মধ্যে যৎসামান্য যে নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে তাতে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সহসাই বা কয়েকদিনের মধ্যে এই সংঘাত থেমে যাবে।
হোয়াইট হাউস ও ইসরাইলি কর্মকর্তাদের মতে, এই লড়াই চলবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভিডিও বার্তায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, আয়াতুল্লাহ (আলি খামেনি)-এর শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি স্থাপনা ও প্রতিটি টার্গেটে হামলা করছে ইসরাইল। ইরানও পাল্টা হুমকি দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইসরাইল শত্রুতা অব্যাহত রাখলে তাদের হামলা আরও তীব্র হবে। ওদিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর সহ রাজধানী তেহরানে অনেক টার্গেটে ব্যাপক হামলা করেছে ইসরাইলের বিমান বাহিনী। ইরানের বার্তা সংস্থা তাসনিম রিপোর্টে বলেছে, প্রশাসনিক ভবনের অল্প ক্ষতি হয়েছে।
ইরানের দক্ষিণে ‘সাউথ পার্স’ প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রেও হামলা করেছে ইসরাইল। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র। এ ছাড়া সাহারান তেল ডিপোতে হামলা করেছে তারা। এতে সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। হাইফায় অবস্থিত একটি তেল শোধনাগারে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেছে তেহরানে তেল বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইসরাইল দাবি করছে তারা ইরানের সামরিক, পারমাণবিক, তেলক্ষেত্রে হামলা করেছে। কিন্তু ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ রেজা জাফরঘান্ড বলেছেন- ইসরাইলের হামলায় নিহত ও আহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এ বিষয়ে পরিষ্কার পরিসংখ্যান দেয়া হয়নি। অন্যদিকে ইসরাইলের বেসামরিক স্থাপনায় আঘাত করে সাধারণ নাগরিকদের হত্যার অভিযোগ এনেছে ইসরাইল। সিএনএনের একটি টিম রোববার ইরানের হামলায় ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হওয়া ইসরাইলের কেন্দ্রীয় অঞ্চল বাত ইয়াম শহর পরিদর্শন করে।
স্থানীয় সময় শনিবার রাত আড়াইটার দিকে সেখানে বৃষ্টির মতো ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এতে বেশ কিছু আবাসিক ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেখান থেকে মৃতদের উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিরা আটকে ছিল। তাদেরকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছিল। অন্যদিকে ইরানের পারমাণবিক, সামরিক ও প্রশাসনিক এলাকার কাছে অবস্থানকারী নাগরিকদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইসরাইল। আতঙ্কে রাজধানী তেহরানের মানুষ অন্যত্র সরে যাচ্ছিলেন। সিএনএনের খবরে বলা হয়, তারা উত্তরে কাস্পিয়ান সাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই অঞ্চলটি গ্রামীণ এবং প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা। অধিবাসীরা বলেছেন, এতে রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম সৃষ্টি হয়। ফলে তাদের চলার গতি স্থির হয়ে পড়ে। নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে একটি পরিবারের এক সদস্য বলেছেন, তিনি ছোট্ট দুই সন্তান ও প্রবীণ পিতামাতাকে নিয়ে সরে যাচ্ছেন। তার ভাষায়- আমি ঘর ছাড়তে চাই না। কিন্তু তাই বলে তো আমার ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাকে এই অবস্থায় রাখতে পারি না। আমি আশা করি যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নিলে এই দুটি দেশকে থামাতে পারে।
প্রেসিডেন্ট হারজগ: ‘ভয়াবহ ক্ষতি’তে শোকার্ত দেশ, খুব দুঃখজনক ও কঠিন সকাল পার করছে ইসরাইল: ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ বলেছেন, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ৮ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। এরপর দেশটি রোববার একটি ‘খুব দুঃখজনক ও কঠিন সকাল’ পার করছে। হারজগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেয়া এক বার্তায় বলেন, তিনি এই হামলাকে ‘অপরাধমূলক ইরানি হামলা’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। আহতদের দ্রুত সুস্থতা ও নিখোঁজদের নিরাপদে খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করছেন। এর আগে জানানো হয়েছিল, তেল আবিবের দক্ষিণে বাত ইয়াম শহরে হামলার পর অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে বলে ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়। হারজগ বলেন, এই শোকের মুহূর্তে পুরো জাতি একসঙ্গে দাঁড়িয়েছে। আমরা আমাদের নাগরিকদের পাশে আছি, যারা আজ (রোববার) সকালে ভীষণ বেদনা ও ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন।
ইরানের আকাশসীমা দখলের দাবি ইসরাইলের ‘আকাশে যুদ্ধবিমান দেখা যাবে, তেহরান জ্বলবে’: ইরানের রাজধানী তেহরানের আকাশসীমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দাবি করেছে ইসরাইল। পাশাপাশি তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে- ইরান যদি আরও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, তবে ‘তেহরান জ্বলবে’। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজের এই হুঁশিয়ারি এসেছে ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রেক্ষিতে। উল্লেখ্য, ইরানের সর্বশেষ হামলার ভয়াবহতা খুবই গভীর। শনিবার দিবাগত রাতে ইরানের নতুন ধরনের ‘হাজ ক্ষেপণাস্ত্র’ হামলার পর ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানিতে বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ। তিনি বলেছেন, ভয়াবহ ক্ষতিতে শোকার্ত তার দেশ। রোববারের সকালের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, খুব দুঃখজনক ও কঠিন সকাল পার করছে ইসরাইল। ওদিকে লন্ডনের প্রভাবশালী অনলাইন গার্ডিয়ান এক রিপোর্টে বলছে, ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) শনিবার সকালের দিকে তেহরানের আশপাশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে এবং তারা জানায় তারা ‘আকাশপথে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, খুব শিগগিরই তেহরানের আকাশে ইসরাইলি যুদ্ধবিমান দেখা যাবে। এরপরেই ইরানের কঙ্গান বন্দরের একটি বিশাল গ্যাস শোধনাগারে বিস্ফোরণ ঘটে। ইরানি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, এটি ইসরাইলি ড্রোন হামলার ফল, যদিও ইসরাইল তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। এর পাশাপাশি রোববার ভোরে নতুন করে উভয় পক্ষ হামলা চালায়। ইসরাইল জানায়, তারা তেহরানে সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। ইরান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এর কিছু ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে আঘাত হানে।
তেহরানে শাহরান তেল ডিপো ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভবনে হামলার খবরও নিশ্চিত করেছে ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম। একইসঙ্গে তেহরান সংলগ্ন একটি আবাসিক ভবনে আঘাতে অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করছে ইরান। এর মধ্যে ২০ জন শিশু। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা এ পর্যন্ত ১৫০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে শত শত বোমা ফেলেছে এবং ইরানের দুই শীর্ষ জেনারেল গোলাম-রেজা মারহাবি ও মোহাম্মদ হোসেইন বাঘেরিকে হত্যা করেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান ঘোষণা দিয়েছেন, ইসরাইলি হামলা চললে আরও কঠোর ও ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া আসবে। নতুন রেভ্যুলুশনারি গার্ডস কমান্ডার বলেছেন, আমরা নরকের দরজা খুলে দেবো। ইরান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন বা ফ্রান্স যদি ইসরাইলের সহায়তায় ইরানের ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করে, তবে তাদের ঘাঁটি ও নৌবাহিনীকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হবে।
ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে ইসরাইলের হামলা: ইসরাইল নিশ্চিত করেছে তারা ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে বিমান হামলা চালিয়েছে। এর আগে ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এই হামলার খবর দেয়। ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা বিপুল পরিমাণ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তেহরানের একাধিক স্থানে হামলা চালিয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন সিএনএন। আইডিএফ বিবৃতিতে বলেছে, লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে ছিল ইরানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর, এসপিএনডি পারমাণবিক প্রকল্পের প্রধান কার্যালয় এবং আরও কিছু স্থান, যেখানে ইরানি সরকার তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি গোপনে পারমাণবিক আর্কাইভ লুকিয়ে রেখেছিল। উল্লেখ্য, ইরান যদিও তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে, তবুও তারা বারবার দাবি করে এসেছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করছে না। ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, হামলায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রশাসনিক ভবনে সামান্য ক্ষতি হয়েছে। ওই একই এলাকায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা অর্গানাইজেশন অব ডিফেন্স ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্সের একটি দপ্তরেও আরেকটি হামলা চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এবং সিএনএনের জিওলোকেট করা কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, হামলার পরপরই ওইসব এলাকা থেকে ধোঁয়া উড়ছে।
ইসরাইল আক্রমণে ইরানের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ‘হাজ কাসেম’: ইরান দাবি করেছে ইসরাইলের ওপর হামলায় তারা নতুন ধরনের নির্দেশনাযুক্ত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। ইরানের রাষ্ট্র-সমর্থিত সংবাদ সংস্থা ফার্স জানিয়েছে, শনিবার রাতভর হামলার সময় ইসরাইলে ‘হাজ কাসেম’ নামের গাইডেড ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন সিএনএন। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আজিজ নাসিরজাদেহ ৪ঠা মে ইরানি টেলিভিশনে বলেন, এই নতুন ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন থাড প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা এবং ইসরাইলের অন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে পাশ কাটাতে সক্ষম। বার্তা সংস্থা তাসনিমের তথ্য অনুযায়ী- এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ‘সলিড ফুয়েল’চালিত। এর পাল্লা ১২০০ কিলোমিটার। এটি ‘ম্যানুভারেবল ওয়ারহেড’ দিয়ে সজ্জিত, যা মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ভেদ করতে পারে। এতে উন্নত নেভিগেশন সিস্টেম রয়েছে, যা সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটির নামকরণ করা হয়েছে কাসেম সোলেইমানির নামে। উল্লেখ্য, কাসেম সোলাইমানি ছিলেন ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের কুদস ফোর্সের প্রধান। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক হামলায় ইরাকে নিহত হন তিনি। তখনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প।
ইরানের সামনে বিকল্প কী? পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি!: ইসরাইলের হামলার জবাবে ইরান ভয়াবহ পাল্টা হামলা চালালেও দৃশ্যত বড় কোনো অর্জন এখনো নেই তাদের। তারা ইসরাইলের কোনো বড় সামরিক ঘাঁটি, সামরিক স্থাপনা বা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে তাদের যেমন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন, ইসরাইলে তেমনটি ঘটেনি। তবে ইরানের হামলায় ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে ইসরাইলে। ক্রমশ সে চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে। এমন অবস্থায় ইরানের সামনে বিকল্প কী তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ক মধ্যস্থতাকারী অ্যালান আইয়ার বলেন, ইরানের বিকল্পগুলো খুবই অপ্রতুল এবং সংকুচিত। তারা অন্তত সামান্য সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাতেই বাধ্য। কারণ এতে তাদের ঘরোয়া মর্যাদা রক্ষা হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ইসরাইল এতটাই শক্তিশালী ও প্রস্তুত যে, ইরান তেমন কোনো কৌশলগত ক্ষতি করতে পারছে না। ফলে ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের হামলা বন্ধ করানো প্রায় অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, ইরান কূটনৈতিক পথ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তাদের আন্তর্জাতিক মিত্রের সংখ্যা কম। আর ইসরাইল বারবার প্রমাণ করেছে, আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে তারা নিজের সামরিক লক্ষ্য পূরণে অটল। আইয়ারের মতে, ইরানের সবচেয়ে সম্ভাব্য কৌশল হলো- এই পরিস্থিতিকে সহ্য করা, যতটা সম্ভব প্রতিশোধ নেয়া এবং পরে একটি নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ করা। এই কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক অংশ হলো- এই নতুন কৌশলে তারা সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথ বেছে নিতে পারে-কেবল সক্ষমতা ধরে রাখা নয়, বাস্তবে অস্ত্র তৈরি করতে পারে।
মার্কিন স্বার্থে হামলা চালালে ইরানকে অভাবনীয় শক্তিতে জবাব দেয়া হবে- ট্রাম্প: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরান ও ইসরাইল সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন- শনিবার দিবাগত রাতে ইরানে যেসব হামলা হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এদিকে ইরান আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা ইসরাইলকে সাহায্য করে, তাহলে তার জবাব দেবে তেহরান। এই প্রেক্ষিতে ট্রাম্প বলেন, যদি আমাদের ওপর কোনোভাবেই ইরান আক্রমণ চালায়, তাহলে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনী এমন শক্তি দিয়ে জবাব দেবে যা পৃথিবী এর আগে কখনো দেখেনি। তবে এর পাশাপাশি তিনি আশার বাণীও দিয়েছেন। বলেছেন, আমরা খুব সহজেই ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে একটা চুক্তি করাতে পারি এবং এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারি।
তার এই মন্তব্য ইরান-ইসরাইল উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ ভূমিকার ইঙ্গিত দেয়। ট্রাম্পের বক্তব্য একদিকে যেমন শক্তি ব্যবহারের হুঁশিয়ারি, অন্যদিকে তেমনি শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনাও তুলে ধরছে।