Image description

সত্যি হয়েছে আশঙ্কা। গতকাল সকালে ইরানের পরমাণু কেন্দ্র ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ভা-ারসহ একাধিক জায়গায় বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। তারপরেই একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে তেহরান। ইসরাইলি হামলায় প্রাণ যায় ইরান রেভলিউশনারি গার্ডের (আইআরজি) হোসেন সালামিসহ ৬ বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর। তেহরানও বসে থাকেনি। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইসরাইলের ওপর ১০০টিরও বেশি ড্রোন হামলা চালায় ইরান। তারপর থেকেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইসরাইলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম। ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরাইলি বাহিনীর চালানো হামলার পর ইরানের জুমকারান মসজিদের ওপরে ‘রক্তের প্রতিশোধের লাল পতাকা’ উত্তোলিত হয়েছে। যা ইসরাইলের হামলার পর ইরানের প্রতিক্রিয়ার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শিয়া মুসলমানদের জন্য লাল পতাকা এক বিশেষ প্রতীক। 

সাধারণত ইসলামী মাস মুহাররমে, বিশেষ করে কারবালার যুদ্ধ ও ইমাম হোসেন (আ.)-এর শাহাদাত স্মরণে এই পতাকা উত্তোলন করা হয়। তবে মুহাররম মাস ছাড়া এ পতাকা উত্তোলন অত্যন্ত বিরল ঘটনা। পতাকাটি প্রতিশোধ ও শোকের এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে। এ পতাকায় লেখা রয়েছে, ‘ইয়া লা-সারাত আল-হোসেইন’। এর অর্থ হলোÑহে হোসাইনের প্রতিশোধ গ্রহণকারীরা। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (আ.) শিয়া ইসলামের অন্যতম পবিত্রতম চরিত্র। তাকে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান ইরাকের কারবালায় উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদের সেনাদের হাতে তিনি শহীদ হন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পতাকা উত্তোলন ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের শক্ত বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এক্সে প্রকাশিত ইরানের তাসনিম সংবাদ সংস্থার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কুম শহরের জামকারান মসজিদে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীরা ইরানের পতাকা হাতে নিয়ে ইসরাইলবিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন। তেহরান থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কুম শহর ইরানের অন্যতম পবিত্র নগরী। গতকাল ভোরে চালানো ইসরাইলি হামলায় উচ্চপদস্থ সামরিক কমান্ডার, পরমাণুবিজ্ঞানী, নারী-শিশুসহ বহু মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এই ঘটনার পর দেশজুড়ে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, হামলায় আবাসিক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শিশুদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া, ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান কার্যালয়ের ওপরও হামলা হয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন আইআরজিসি’র কমান্ডার হোসেইন সালামি। ওই হামলায় নিহত ইরানি কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই সম্ভবত সিনিয়র পদাধিকারী। বেসরকারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তেহরানে আবাসিক ভবনগুলিতে ইসরাইলি হামলায় ৭৮ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৩২৯ জন আহত হয়েছেন। তেহরানের ফুটেজে শহরের পশ্চিম, পূর্ব এবং উত্তর অংশে ভবন কমপ্লেক্সের ব্যাপক ক্ষতি দেখা যাচ্ছে। পূর্ব আজারবাইজান, এসফাহান এবং কেরমানশাহসহ প্রদেশে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং সামরিক ঘাঁটিগুলিকেও লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সাহায্য কর্মীরা ঘটনাস্থলে রয়েছেন, যেখানে ক্ষতিগ্রস্তরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরাইলকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের নিন্দা : হামলার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বনেতারা উত্তেজনা এড়াতে সব পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজকে বলেন, ইরানে ইসরাইলের হামলা হওয়ার আগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটা ঘটতে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘ইরানের কাছে পারমাণবিক বোমা থাকতে পারবে না। আমরা চাই আবার আলোচনার টেবিলে ফিরে যেতে। দেখা যাক কী হয়।’ ট্রাম্প আরও বলেন, ইরান যদি পাল্টা হামলা করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ও ইসরাইলকে রক্ষা করতে প্রস্তুত আছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের সংঘাত ঠেকাতে সব পক্ষকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। গুতেরেসের উপমুখপাত্র ফারহান হক বলেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিব মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো ধরনের সামরিক উত্তেজনা বাড়াকে নিরুৎসাহিত করেন।’ ফারহান আরও বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বেগ জানিয়েছেন। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলার মধ্যে এমন হামলা হলো।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ইসরাইলের এমন হামলার পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নতুন করে উত্তেজনা এড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার পারমাণবিক আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে ওমান। দেশটিও ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে। তারা এটিকে ইসরাইলের বিপজ্জনক ও বেপরোয়া কর্মকা- উল্লেখ করে বলেছে, এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন হয়েছে। এ ধরনের আগ্রাসী ও নির্বিচার আচরণ অগ্রহণযোগ্য। এতে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা ক্ষুণœ হবে। ওমানের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ইসরাইলকে সরাসরি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকেশি ইওয়াইয়া বলেন, ‘আমরা ইসরাইলের এই হামলার কঠোর নিন্দা জানাচ্ছি। এ ধরনের কাজ মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।’ তাকেশি সব পক্ষকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানো এবং দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। এক বিবৃতিতে সউদী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ইসরাইলি পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। এতে বলা ‘ভ্রাতৃপ্রতিম ইরানকে লক্ষ্য করে ইসরাইলের চালানো এই প্রকাশ্য আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে সউদী আরব। এটি ইরানের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে ক্ষুণœ করেছে এবং এটি আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।’
ইরানে ইসরাইলের হামলার কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাশিয়া ও তুরস্কও। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বিভিন্ন সংবাদ সংস্থাকে বলেন, ‘ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে হঠাৎ করে যে ভয়াবহ উত্তেজনা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে রাশিয়া উদ্বেগ ও নিন্দা জানাচ্ছে।’ তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ইসরাইলকে ‘আগ্রাসন বন্ধ করার’ আহ্বান জানিয়েছে। ইসরাইলের চালানো হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়েছে আঙ্কারা।

ভয়ে আত্মগোপনে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু : ইরানে ভয়াবহ হামলা চালানোর পরেই পাল্টা হামলা থেকে বাঁচতে আত্মগোপন করেছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সম্ভবত গ্রিসের কোনও গোপন আস্তানায় তিনি ঠাঁই নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী যেমন প্রাণ বাঁচাতে গা ঢাকা দিয়েছেন, তেমনই ইরানের হামলা থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ইসরাইলি দূতাবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, বিদেশে বসবাসকারী এবং ভ্রমণে যাওয়া ইসরাইলি নাগরিকদের উদ্দেশে বিশেষ সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি কোনও অবস্থাতেই ইহুদি বা ইসরাইলি প্রতীক প্রকাশ্যে বহন না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ‘চ্যানেল ১২’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইরানে হামলা চালানোর খানিকবাদেই তেল আভিভ ছেড়ে পালিয়েছেন নেতানিয়াহু। দুটি যুদ্ধবিমানের পাহারায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর বিমান দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে অবতরণ করেছে। সেখানে নেমেই এক গোপন আস্তানায় চলে গিয়েছেন তিনি।
ইসরাইল ‘করুণ পরিণতির’ মুখোমুখি হবে : ইরানে ইসরাইলি হামলার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, তিনি বলেছেন যে এই হামলা ইসরাইলের ‘বর্বর স্বভাবের প্রমাণ’। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে আরও বলেছেন, ‘এই হামলার মাধ্যমে ইসরাইল নিজেই নিজের জন্য একটি করুণ পরিণতির পথ তৈরি করেছে, যার ফলাফল তারা নিশ্চিতভাবেই ভোগ করবে।’
পাল্টা হামলার ভয়ে আতঙ্ক ইসরাইলে : ইরানে হামলার পর থেকেই নিজেদের সতর্ক করেছে ইসরাইল। ইতিমধ্যেই সে’দেশের মানুষ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আতঙ্কে ঘরে জমা করতে শুরু করেছে খাদ্যবস্তু। জেরুজালেমের সুপার মার্কেটগুলি থেকে নিমেষে উধাও হচ্ছে খাবার। রাস্তাঘাট একেবারে শুনশান। জানা গিয়েছে, গতকাল ভোর রাতে সাইরেনের শব্দ ও মোবাইলের সতর্কবার্তায় ঘুম ভাঙে ইসরাইলের জনগণের। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় দেশ এখন বিপদের সম্মুখীন। তাই সবাই যেন আশ্রয়কেন্দ্রের কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করে। ইসরাইলের জরুরি বিভাগ জানিয়েছে, সারা দেশে আগে থেকেই রক্ত সংগ্রহের কাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলিতে বেড ফাঁকা করা হচ্ছে। যারা মোটামুটি বাড়ি যাওয়ার মতো সুস্থ তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পশ্চিম তীরে সব ফিলিস্তিনি শহরে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ইরানি হামলায় যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়, তার জন্যই এত ব্যবস্থা গ্রহণ।

ইসরাইলকে ‘প্রতিহত করতে’ বার্তা হামাসের : ইরানে হমালার পর ইসরাইলকে ‘প্রতিহত করতে’ এবং ‘এর অপরাধ বন্ধ করতে’ বিশ্বের প্রতি ‘একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান’ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। টেলিগ্রামে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরাইলের আগ্রাসন একটি বিপজ্জনক উত্তেজনা সৃষ্টি করছে যা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার হুমকি দিচ্ছে। এটি চরমপন্থি নেতানিয়াহু সরকারের অঞ্চলকে উন্মুক্ত সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জেদের প্রতিফলন।’
হামাস এই হামলাকে ‘একটি নৃশংস আগ্রাসন যা আন্তর্জাতিক নিয়ম ও প্রথার চরম লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছে। তারা বলেছে, এই হামলা আবারও নিশ্চিত করল যে, ইসরাইল ‘সমগ্র অঞ্চলের জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি’। হামাস ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতি পূর্ণ সংহতি’ প্রকাশ করেছে এবং সিনিয়র কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের মৃত্যুর জন্য ইরানি নেতৃত্ব ও জনগণের প্রতি ‘গভীর সমবেদনা’ জানিয়েছে।
হামলার খবরে বেড়েছে তেল ও সোনার দাম : ইরানে ইসরাইলের হামলার খবরের পর আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে তেল ও সোনার দাম। আন্তজার্তিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুডে তেলের দাম ১.৮% বেড়ে ব্যারেল প্রতি ৮৮ ডলার হয়েছে বলে খবর দিয়েছে বিবিসি। একইসঙ্গে সোনার দাম অল্প সময়ের জন্য রেকর্ড উচ্চতায় ওঠার পর আউন্স প্রতি ২ হাজার ৪০০ ডলারে ঠেকেছে। সূত্র : আল-জাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি, তেহরান টাইমস।