Image description


ভৌগোলিক অবস্থান এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ডাইনামিক্স  এর কারনে তুরস্ক অত্যন্ত হাই রিস্ক  জোনে অবস্থিত। এই কারনে তুরস্ক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  খেলোয়াড়। কিন্তু খেলোয়াড়ের হাতে যদি সাজ সরঞ্জাম না থাকে তাহলে সে হয়ে যাবে অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের খেলার মাঠ।  যে যেভাবে পারবে লাথি উষ্ঠা মারবে, কিন্তু ফসল তুলবে নিজের ঘরে। যা ঠেকাতে  তুরস্ককে তার  প্রতিরক্ষা খাতকে শক্তিশালী বানাতে হচ্ছে, আর সেই সাথে স্বনির্ভর।  


আজকের ফোকাস তুরস্কের সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ইন্ডাস্ট্রি নয়, বরং ফোকাস তাদের ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেট কান (KAAN) তৈরির পটভূমির উপর। দেখব তুরস্ক কিভাবে তার এফ-১৬ আর এফ-৩৫ থেকে কানে এসে তরী ঠেকাল। 


এফ-১৬ঃ ১৯৮০-এর দশকে তুর্কি বিমান বাহিনী তার পুরনো যুদ্ধবিমান (যেমন এফ-৪ ফ্যান্টম) প্রতিস্থাপনের জন্য আধুনিক মাল্টিরোল ফাইটার জেটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ন্যাটোর মেম্বার রাষ্ট্র হিসাবে তুরস্ক বেছে নেয় এফ-১৬, যা তখন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে ছিল একটি । ১৯৮৪ সালে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফ-১৬ সংগ্রহের জন্য একটি বড় চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার নাম ছিল "Peace Onyx" প্রোগ্রাম। এই চুক্তির অংশ হিসেবে তুরস্ক শুধু বিমান ক্রয়ই করেনি, বরং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগও পায়।


লকহিড মার্টিন (তৎকালীন জেনারেল ডায়নামিক্স) এবং তুরস্কের মধ্যে একটি প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে তুরস্কের তুসাস (TUSAŞ - Turkish Aerospace Industries) এফ-১৬-এর কিছু অংশ উৎপাদন এবং সাব-অ্যাসেম্বলির দায়িত্ব পায়। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল:
- তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি।
- স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
- বিদেশি মুদ্রার উপর নির্ভরতা কমানো।
তুসাস ১৯৮৭ সাল থেকে এফ-১৬-এর উৎপাদন শুরু করে। তারা বিমানের ফিউজলেজের পিছনের অংশ, উইং, টেইল সেকশন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তৈরি ও এসেম্বলি  করতে শুরু করে। তুরস্কে মোট ২৪০টিরও বেশি এফ-১৬ বিমানের সাব-অ্যাসেম্বলি সম্পন্ন হয়, যা তুর্কি বিমান বাহিনীর জন্য সরবরাহ করা হয়।
তুসাস তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। এফ-১৬ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ তুসাসকে উন্নত বিমান প্রযুক্তি এবং উৎপাদন কৌশল শিখতে সাহায্য করে। এই অভিজ্ঞতা তুরস্ককে পরবর্তীতে নিজস্ব প্রকল্প, যেমন হুরজেট (Hürjet) এবং টিএফ-এক্স (TF-X, বর্তমানে কান নামে পরিচিত) জাতীয় যুদ্ধবিমান প্রোগ্রামে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে।  


এফ-৩৫ঃ এফ-৩৫ প্রোগ্রামে তুরস্কের সম্পৃক্ততা ন্যাটোর সদস্য হিসেবে তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার অংশ ছিল।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ২০০০-এর দশকের শুরুতে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এফ-৩৫ লাইটনিং II প্রোগ্রাম শুরু হয়, যার লক্ষ্য ছিল একটি বহুমুখী, স্টেলথ-সক্ষম যুদ্ধবিমান তৈরি করা। তুরস্ক ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে Joint Strike Fighter সংক্ষেপে JSF প্রোগ্রামে যোগ দেয়, যুক্তরাজ্য, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং নেদারল্যান্ডসের মতো ন্যাটো মিত্রদের সঙ্গে।
তুরস্ক প্রোগ্রামের উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক বিনিয়োগ করে, যা এটিকে প্রোগ্রামের লেভেল-৩ অংশীদার (Level 3 Partner) করে। এই অবদান তুরস্ককে বিমান ক্রয়ের পাশাপাশি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়। 


তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প, বিশেষ করে তুসাস (TUSAŞ - Turkish Aerospace Industries), আলপিনা হাভাজিলিক (Alp Aviation), আসেলসান (Aselsan) এবং অন্যান্য কোম্পানি এফ-৩৫-এর বিভিন্ন সাব-সাব-সিস্টেম বা উপাদান তৈরির দায়িত্ব পায়। যেমন, সেন্টার ফিউসেলেজ, ল্যান্ডিং গিয়ার,  ইঞ্জিন সাবকম্পনেন্টস, হাইড্রলিক ফিটিংস,  এভিওনিক্স ইন্টারফেইসেস এন্ড ইলেক্ট্রনিক কম্পনেন্টস, এন্টেনা আর সিগ্নাল প্রসেসিং মডিউলস,  ওয়েপন্স বে ইত্যাদি।
এই উৎপাদন কার্যক্রম তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে; গড়ে তুলে অত্যন্ত ভ্যালুয়েবল কর্মী বাহিনী; ফ্রম ম্যানেজমেন্ট টু ইঞ্জিনিয়ার্স, হার্ডওয়্যার টু সফটওয়্যর, ম্যানুফ্যাকচারিং টু কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইত্যাদি। যারা  দেশীয় অর্থনীতির জন্য ২০১৯ পর্যন্ত রেভেনিউ জেনারেট করে $১.৩ বিলিয়নেরও বেশি। 


তুরস্ক প্রাথমিকভাবে ১০০টি এফ-৩৫এ  ক্রয়ের পরিকল্পনা করে এবং ২০১৮ সালে প্রথম দুটি বিমান গ্রহণ করে। এই বিমানগুলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে আরও ৪টি বিমান তৈরি করা হয়, যা তুরস্কের জন্য প্রস্তুত ছিল কিন্তু হস্তান্তর করা হয়নি। তুরস্কের পরিকল্পনা ছিল এই বিমানগুলো তুর্কি বিমান বাহিনীর পুরনো এফ-৪ ফ্যান্টম এবং এফ-১৬-এর কিছু অংশ প্রতিস্থাপন করবে।
২০১৯ সালে, রাশান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এস-৪০০ ক্রয় করার দায়ে  যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ-৩৫ প্রোগ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং তাদের জন্য তৈরি বিমান হস্তান্তর বন্ধ করে দেয়। তুরস্কের তৈরি উপাদানগুলোর উৎপাদনও এরপর ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়া হয়। 


২০১৯ সালে এফ-৩৫ প্রোগ্রাম থেকে তুরস্ককে বাদ দেওয়ার পর, তুরস্ক তার বিমান বাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে মনোযোগ দেয়। এফ-৩৫-এর স্টেলথ এবং উন্নত প্রযুক্তির বিকল্প হিসেবে তুরস্ক নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে TF-X প্রোগ্রাম চালু হয়, যা পরে KAAN নামে পরিচিত হয়।
কান প্রোগ্রামের নেতৃত্বে রয়েছে তুসাস, যা তুরস্কের শীর্ষস্থানীয় মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা কোম্পানি। তুসাস এফ-১৬ এবং এফ-৩৫ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কানের নকশা, উৎপাদন এবং পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করছে। তুসাসের সাথে কান প্রগ্রামে জড়িত আছে বিএই, আসেলসান, রকেটসান, আর টড়-মোটর ইত্যাদি কোম্পানি।  তুসাসের নেতৃত্বে প্রায় ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, এবং সহায়ক কর্মী এই প্রকল্পে সরাসরি জড়িত।


 রাতারাতি কোন ইন্ডাস্ট্রি বা প্রোগ্রাম গড়ে উঠে না। তার একটা লেগ্যাসি লাগে, সাথে থাকে চলমান একটা যাত্রাপথ , বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী। আর এসবের জন্য  সবচেয়ে বড় যা লাগে তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ফান্ড বা বাজেট, আর সহযোগিতা।

ড সাবিনা আহমেদ