
চীনের পক্ষ থেকে আসা সম্ভাব্য হুমকির বিষয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের মিত্রদের সরাসরি সতর্ক করলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। শনিবার সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ‘শাংরি-লা ডায়ালগ’ নিরাপত্তা সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমরা কথাটি লঘু করে বলছি না,চীনের হুমকি বাস্তব। এবং এটি যে কোনো সময় সামনে আসতে পারে।"
যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাবি করেন, চীন এখন শুধু সামরিক শক্তি বৃদ্ধি নয়, বরং তাইওয়ান আক্রমণের প্রশিক্ষণও চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “তাইওয়ান ঘিরে অবরোধ অনুশীলনের মাধ্যমে চীনের সেনাবাহিনী এখন মূল অভিযানের মহড়া চালাচ্ছে।” এ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজের সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার করবে বলেও জানান হেগসেথ। তবে একই সঙ্গে তিনি আঞ্চলিক মিত্রদের প্রতিও আহ্বান জানান, যেন তারা ইউরোপের মতো নিজেদের প্রতিরক্ষা বাজেট মোট দেশজ উৎপাদনের ৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করে।
হেগসেথ বলেন, “একটি সুসংগঠিত, দৃঢ় এবং সক্ষম জোটই আমাদের সবচেয়ে বড় কৌশলগত সম্পদ। চীন আমাদের এই ঐক্যকে হিংসা করে।”
চীনের পক্ষ থেকে সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রতিনিধি, ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির রিয়ার অ্যাডমিরাল হু গাংফেং যুক্তরাষ্ট্রের এসব মন্তব্যকে 'ভিত্তিহীন' বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, “কিছু অভিযোগ পুরোপুরি মনগড়া, কিছু আবার তথ্য বিকৃতি, আর কিছু ঠিক চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের মতো নিজে কিছু করে আবার অন্যকে দোষারোপ করা।”
তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এই অঞ্চলে অস্থিরতা ও দ্বন্দ্ব উসকে দিচ্ছে। যদিও বেইজিং দীর্ঘদিন ধরে ২০২৭ সালের মধ্যে তাইওয়ান দখলের লক্ষ্য ঘোষণা করেছে, অনেকেই এটিকে এখনো উচ্চাভিলাষী মনে করলেও পেন্টাগন চীনের মহাকাশ, হাইপারসনিক প্রযুক্তি ও নৌবাহিনীর উন্নতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। হেগসেথ জানান, এই উদ্বেগের ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশভিত্তিক ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা নিচ্ছে।
মিত্রদের উদ্দেশে হেগসেথ স্পষ্টভাবে বলেন, “আপনারা যদি অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তাহলে তা তাদের কৌশলগত প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দেবে এবং সংকটকালে আমাদের প্রতিরক্ষা সিদ্ধান্ত গ্রহণ জটিল হয়ে পড়বে।” তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নিরাপত্তা চাওয়া আর অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর নির্ভরতা এই দুই অবস্থান একসাথে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ।
ট্রাম্প প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাটালিয়ন সরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো ও কোস্ট গার্ড শিপ যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে পাঠানোর বিষয়ে হেগসেথ বলেন, “হুথিদের হামলা ও অবৈধ অভিবাসন রোধে এটি ছিল জরুরি পদক্ষেপ।” তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ‘অগ্রাধিকার’ তালিকার শীর্ষে আছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সম্মেলনে উপস্থিত ইলিনয় থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট সিনেটর ট্যামি ডাকওয়ার্থ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশকে আমাদের আর চীনের মধ্যে পক্ষ নিতে বলছে না।”
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিচার্ড মার্লেস যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া কার্যকর শক্তির ভারসাম্য গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে একে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ছেড়ে দেওয়াও যাবে না।”তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ শুল্কনীতি অনেক 'আঘাত' ও 'বাধা' সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে হেগসেথ বলেন, “আমি ট্যাংকের ব্যবসা করি, বাণিজ্যের নয়।”
চীনের অনুপস্থিতি, যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা
এবারের সম্মেলনে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অংশ না নেওয়াকে অনেকেই মার্কিন শুল্কনীতির প্রতি অসন্তোষের ইঙ্গিত বলেই দেখছেন। হেগসেথ পরোক্ষভাবে মন্তব্য করেন, “আমরা এখানে উপস্থিত, আর কেউ কেউ নেই।”কূটনৈতিক বৈচিত্র্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমরা ঐতিহ্যগত এবং অনানুষ্ঠানিক সব ধরনের মিত্রদের প্রতি উন্মুক্ত। আমাদের সমর্থন পেতে হলে আপনাকে সংস্কৃতি বা জলবায়ু ইস্যুতে একমত হতে হবে না।”
হেগসেথ তাঁর বক্তব্যের শেষাংশে বলেন, “চীন খুব ভালোভাবেই জানে, আমরা একসাথে হলে প্রতিরক্ষায় কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারি। তবে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।”
চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রস্তুতি, যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো হুঁশিয়ারি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন উত্তেজনার কেন্দ্রে। হেগসেথের বার্তায় একদিকে যেমন সতর্কতা ছিল, তেমনি ছিল ঐক্যের আহ্বান। ২০২৫ সালের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এখন বিশ্ব শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ হতে চলেছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র:https://tinyurl.com/48jwu8hr