Image description
 

বিংশ শতাব্দীর শেষ দিনে ভ্লাদিমির পুতিন যখন রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, তখন অনেকের কাছেই সাবেক এই গোয়েন্দা ছিলেন এক রহস্য। বিবিসির ইতিহাসবিষয়ক আয়োজন ‘ইন হিস্ট্রি’ এই নেতার কঠিন শিশুকাল থেকে ক্ষমতার পথযাত্রা খতিয়ে দেখেছে।বরিস ইয়েলৎসিন ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সবাইকে হতবাক করে দিয়ে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। টেলিভিশন দর্শকদের উদ্দেশে দেওয়া ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘রাশিয়াকে অবশ্যই নতুন সহস্রাব্দে প্রবেশ করতে হবে নতুন রাজনীতিক, নতুন মুখ, নতুন বুদ্ধিমত্তা, শক্তিশালী ও তেজস্বী মানুষকে নিয়ে।’দুর্নীতির ছড়াছড়ি এবং ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার মধ্যে ইয়েলৎসিনের প্রশাসন ক্রমেই অজনপ্রিয় ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তিনি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের একজন মুখ্য সংঘটক ছিলেন। তাঁর দায়িত্বকাল রাষ্ট্রপরিচালিত কমিউনিস্ট অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যাওয়ার ক্রান্তিকাল। রাশিয়ার জন্য সেটা কষ্টকর সময়।

 

নতুন সহস্রাব্দের জন্য নতুন মুখ হিসেবে ইয়েলৎসিনের আপাত–উত্তরসূরি পুতিন ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে ভাষণ দেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘ক্ষমতায় কোনো শূন্যস্থান থাকবে না।’এ সময় পুতিন সতর্কতাও দেন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার আইন ও সংবিধানের সীমা অতিক্রম করার যেকোনো প্রচেষ্টা চূড়ান্তভাবে ধূলিসাৎ করা হবে।’ইয়েলৎসিনের খামখেয়ালি আচরণ দেখতে অভ্যস্ত দেশে মেদহীন, সুঠামদেহী, কর্মক্ষম ও নেশামুক্ত পুতিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ইয়েলৎসিন এতই মদ্যপ ও অসুস্থ ছিলেন যে কখনো কখনো তাঁকে তাঁর কার্যালয়ে দেখা গেলে তা খবরের শিরোনাম হয়ে যেত।পুতিন ১৯৯৯ সালের আগস্টে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। এর আগপর্যন্ত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির এই সদস্য তেমন পরিচিত কেউ ছিলেন না। একই বছরের শেষ দিকে রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চেচনিয়া যুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণে পুতিন জনপ্রিয়তা লাভ করেন।২০০০ সালের মার্চে রাশিয়ার জাতীয় নির্বাচনের প্রথম ধাপে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন পুতিন। সমীক্ষায় দেখা যায়, বেশির ভাগ রুশ নাগরিক ওই সময় সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চেয়েছিলেন।

 

২৫ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন পুতিন। সোভিয়েত স্বৈরশাসক জোসেফ স্তালিনের পর এত লম্বা সময় ধরে কেউ রাশিয়াকে শাসন করেননি।ভোটারদের প্রতি পুতিনের মৌলিক বার্তা ছিল যে তিনি রাশিয়াকে আবার শক্তিশালী করে গড়ে তুলবেন।বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশের নতুন এই নেতা শীর্ষে উঠেছিলেন তেমন কোনো নিশানা না রেখেই। এটি স্পষ্ট ছিল যে তখনকার ৪৭ বছর বয়সী পুতিন এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি নিজেকে শক্তপোক্ত কঠোর হিসেবে দেখতে এবং সেভাবেই কথা বলতে পছন্দ করতেন। যেমন জুডোতে ব্ল্যাক বেল্টধারী এই রুশ নেতা বলতেন, আইন ভঙ্গকারীরা ইঁদুর, তাদের পিষে ফেলা উচিত।

 

কিন্তু পুতিন আসলে কেমন মানুষ ছিলেন?

পুতিন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বেড়ে ওঠেন। যে শহর তখন লেলিনগ্রাদ নামে পরিচিত ছিল। জার পিটার দ্য গ্রেট এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। শহরটি পুরোপুরিভাবে পশ্চিমা প্রভাবাচ্ছন্ন ছিল। তবে রাশিয়ার রাজকীয় অতীতের প্রতিচ্ছবিও এই শহর।

পুতিনের একসময়ের জুডো প্রশিক্ষক আনাতোলি রাখলিনের সঙ্গে ২০০১ সালে কথা বলেছিল বিবিসি। তিনি বলেন, পুতিন ছিলেন তারকা ছাত্র। তাঁর মধ্যে অলিম্পিক দলে জায়গা করে নেওয়ার মতো সম্ভাবনা ছিল।

আনাতোলি আরও বলেন, বিজয়ী হওয়ার জন্য পুতিন ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—শক্তি দিয়ে না পারলে কৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। প্রতিপক্ষের জন্য তাঁকে পরাজিত করা বেশ কঠিন কাজ ছিল। কারণ, তিনি বারবার কৌশল পাল্টে তাদের ঘোল খাইয়ে দিতেন।

পুতিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত বছর পর ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের আগে অবরুদ্ধ লেলিনগ্রাদে তাঁর বড় ভাই নিহত হন। সে সময় তাঁর মা-বাবা কোনোমতে বেঁচে যান।

জনাকীর্ণ একটি যৌথ ফ্ল্যাটে বেড়ে ওঠেন পুতিন। সেখানে অনেকগুলো পরিবারকে একটিমাত্র বাথরুম ও রান্নাঘর ব্যবহার করতে হতো। বসবাস করতে হতো ইঁদুর ও তেলাপোকার সঙ্গে।

পুতিন স্মৃতিচারণা করে আত্মজীবনীতে লিখেছেন বালক বয়সে কীভাবে সিঁড়িতে ইঁদুরের সঙ্গে লড়াই করতে হতো তাঁকে।

 
 

পুতিন লিখেছেন, ‘একবার আমি একটি বড় ইঁদুর দেখতে পাই এবং তাড়া করে সেটিকে একটি কোনায় ঠেলে দিই। আচমকা ইঁদুরটি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর সেটি লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে যায়।’সাবেক সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশচেভের পুতি অধ্যাপক নিনা ক্রুশচেভার মতে, পুতিনের বিখ্যাত কোণঠাসা করা ইঁদুরের উপাখ্যানের সুর তাঁর শ্রোতাদের ওপর ভিত্তি করে কমবেশি আক্রমণাত্মক হয়।২০২৩ সালে বিবিসির পডকাস্টে পুতিন সম্পর্কে নিনা বলেছিলেন, তিনি তাঁর সাদামাটা বেড়ে ওঠা, কত দূর এসেছেন, সারা জীবন তাঁকে কত ধরনের শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তা বোঝানোর জন্য সব সময় এই গল্প বলতেন—কীভাবে তিনি ছোট একটি প্রাণীকে সহ্য করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে দেশি-বিদেশি সব ধরনের শত্রুর মোকাবিলা করে উচ্চপর্যায়ে উঠে এসেছেন।

‘যোগ্যতমর টিকে থাকা’

পুতিনের শৈশবের বন্ধু মনোবিজ্ঞানী মারিয়া ওসোরিনা। তিনি ২০০৩ সালে বিবিসিকে বলেছিলেন, তাঁরা (পুতিন ও তাঁর পরিবার) যে কঠিন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, সেখানে বিষয়টি ছিল ‘যোগ্যতমর টিকে থাকা’। মা–বাবার বেশি বয়সের সন্তান হওয়ার কারণে তিনি ছোট, রোগা-পাতলা ও দুর্বল ছিলেন। আর তাই তাঁর কাছে শক্তিশালী হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যাতে তাঁকে মার খেতে না হয়।

মারিয়া বলেন, পুতিনের পরিবারে কর্তব্য, দেশপ্রেম ও আনুগত্যের দৃঢ় মূল্যবোধ ছিল। মা–বাবা তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁদের জীবনের মধ্যমণি ছিলেন পুতিন। তিনি ছিলেন মা–বাবার অনেক আকাঙ্ক্ষিত পুত্রসন্তান। কিন্তু তাঁরা স্বভাবত খুব সংযত প্রকৃতির ছিলেন। তাঁরা তাঁদের আবেগ দেখাতেন না। পুতিনের বাবা ছিলেন বাইরে খুব শীতল, আর মা–ও একই ধারার। এমনকি তাঁরা তাঁদের ছেলেকে জনসমক্ষে চুমু খাওয়ার কথাও চিন্তা করতে পারতেন না।

পুতিনের স্কুলের সহপাঠী সের্গেই কুদ্রভ। তিনি ২০০১ সালে বিবিসিকে বলেছিলেন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতরা তরুণ পুতিনকে বুদ্ধিমান কিন্তু আত্মস্থ হিসেবে মনে রেখেছেন। তিনি কখনোই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন না। তিনি যেকোনো ঘটনায় দূর থেকে প্রভাব রাখতে পছন্দ করতেন। তাঁর স্বভাব ছিল পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। পুতিন একজন অন্তর্মুখী মানুষ, যিনি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী।কেজিবির গোয়েন্দা হওয়া এবং ছদ্মবেশে দেশসেবা নিয়ে রোমান্টিকতা ছিল পুতিনের। সম্ভবত তাঁর মতো এমন একজনের জন্য এটি ছিল উপযুক্ত চাকরি, যিনি তারকাখ্যাতি এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন।

 

১৯৬৮ সালে মুক্তি পাওয়া সোভিয়েত গুপ্তচর ঘরানার চলচ্চিত্র ‘দ্য শিল্ড অ্যান্ড দ্য সোর্ড’ পুতিনকে গোয়েন্দা সংস্থায় যোগ দিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।পুতিন তাঁর শৈশবকালের গোয়েন্দা কর্মকর্তা হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে কখনোই বিচলিত হননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও কেজিবির প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হন।পুতিনের বয়স যখন ১৬, তখন তিনি স্থানীয় কেজিবি সদর দপ্তরে গিয়ে একটি চাকরি চেয়েছিলেন। তারা পুতিনকে আইন অধ্যয়ন করতে এবং তারপর অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।ছয় বছর পর গোয়েন্দা সংস্থাটি পুতিনকে নিয়োগ দেয়। পুতিন ১৬ বছরের বেশি সময় একজন গোয়েন্দার দ্বৈত জীবন উপভোগ করেছেন। বার্লিন প্রাচীরের যখন পতন হয়, তখন তিনি পূর্ব জার্মানিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এরপর তিনি এমন এক রাশিয়ায় ফিরে আসেন, যেটির পুরোনো সব নিশ্চয়তা ভেঙে পড়েছিল।১৯৯১ সালে লেনিনগ্রাদের নতুন মেয়র আনাতোলি সবচাকের ডেপুটি হন পুতিন। পরবর্তী সময়ে ভোটে পরাজিত হওয়ায় সবচাকের স্থলে পুতিনকে বেছে নেয় ক্রেমলিন।

 

ইয়েলৎসিনের প্রশাসন যখন শেষের দিকে খুঁড়িয়ে চলছিল, তখন থেকে ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত সবার অলক্ষ্যে নিজের অবস্থান তৈরি করে নেন পুতিন। অচেনা-অজানা একজন মানুষ হঠাৎ করেই একযোগে সবার কাছে পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন।২৫ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন পুতিন। সোভিয়েত স্বৈরশাসক জোসেফ স্তালিনের পর এত লম্বা সময় ধরে কেউ রাশিয়াকে শাসন করেননি।পুতিনের বয়স এখন ৭২ বছর। তিনি পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৪ সালের শুরুতে বিবিসির পল কিরবি লিখেছিলেন, ‘তাঁর (পুতিন) শাসনের বিরোধিতার সমস্ত লক্ষণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তিনি চাইলে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারেন। আর এ ক্ষেত্রে তাঁকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই বললেই চলে।’