
ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে ১০ই মে যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরেই ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তাতে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ভারতে।
বিষয়টি প্রথম সামনে আনেন কংগ্রেস, কংগ্রেসের সমর্থক এবং সামাজিক মাধ্যমের একাংশ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হেরে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সামনে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর লেফটেনান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজী।
এখন কেন পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণ না করিয়ে যুদ্ধবিরতি মেনে নিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার, সেই প্রশ্ন কংগ্রেসের তরফে সরাসরি তোলা হয় নি, তবে প্রসঙ্গটা নানা টিভি চ্যানেলের 'টক শো'তে অনেকেই তুলেছেন।
কংগ্রেস প্রচার করছে যে ৭১-এর যুদ্ধে যেভাবে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের সময়ে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সেই কথা।
গত সপ্তাহের ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে মধ্যস্থতা করেছে, সেই প্রসঙ্গে কংগ্রেসিরা তুলে আনছেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কথাও।

ছবির উৎস,NIXON LIBRARY
কী বলা হচ্ছে ৭১-এর যুদ্ধ নিয়ে?
কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক এক্স হ্যান্ডেল থেকে প্রচার করা হয়, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের একটি ছবি।
সেখানে লেখা হয় যে "ইন্দিরা গান্ধী নিক্সনকে বলেছিলেন যে আমাদের শিরদাঁড়া সোজা আছে। আমাদের ইচ্ছাশক্তি এবং রসদ রয়েছে যা দিয়ে আমরা সব নৃশংসতার মোকাবেলা করতে পারি। সেই দিন আর নেই যখন তিন-চার হাজার মাইল দূরে বসে কোনও দেশ তাদের মর্জি মতো চলার আদেশ দেবে ভারতীয়দের।"
কংগ্রেস এক্স হ্যান্ডেলে আর লিখেছে, "এটাই হচ্ছে সাহস। এটাই ছিল ভারতের জন্য রুখে দাঁড়ানো আর দেশের মর্যাদার সঙ্গে সমঝোতা না করা।"
কংগ্রেস সহ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী এক শিক্ষক বিকাশ দিব্যকীর্তির একটি পুরনো ভিডিওও শেয়ার করছেন।
ওই ভিডিওতে বিকাশ দিব্যকীর্তি বলছেন, "একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েই পাকিস্তানকে দুই টুকরো করে দিয়েছেন। অন্য লোকেরা বলতে থাকে যে সার্জিকাল স্ট্রাইক করে দেব। তিনি কিন্তু কথা বলেন নি, কাজটা করে দিয়েছিলেন।"
তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, ১৯৭১ সালের সঙ্গে ২০২৫ সালের তুলনা করা ঠিক নয়।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর যখন বাংলাদেশ গঠিত হয়, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল, কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের যা ক্ষমতা ছিল বর্তমানের রাশিয়া তত শক্তিশালী নয়। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ভারতকে সমর্থন করত, আবার পাকিস্তানও তখন পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠে নি।

ছবির উৎস,Getty Images
সামাজিক মাধ্যমে যা লেখা হচ্ছে
কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সামাজিক মাধ্যমের পাতায় যা লিখেছে, তার বাইরেও কংগ্রেসের পরিচিত নেতারাও নিজেদের পেইজে ইন্দিরা গান্ধী ও ৭১-এর যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলছেন।
কংগ্রেস নেতা ছত্তিশগড়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল লিখেছেন, "যতক্ষণ না টুকরো করেছেন, ততক্ষণ ছাড়েন নি।" তিনি পাকিস্তানকে দুটুকরো করা এবং নতুন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।
সাংবাদিক রোহিনী সিং এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, "ভোটে লড়া আর যুদ্ধ করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এমনিই কেউ ইন্দিরা গান্ধী হয়ে ওঠে না।"
কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি চিঠি শেয়ার করে লিখেছেন, " ১৯৭১ সালের ১২ই ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এই চিঠি লিখেছিলেন। এর চার দিন পর পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে।"
কংগ্রেস নেতা এবং কংগ্রেস সমর্থকদের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে যেমন ইন্দিরা গান্ধী ও ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের কথা লেখা হচ্ছে, তেমনই আবার বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবিয়াও বিষয়টি নিয়ে পাল্টা মন্তব্য করেছেন।
তিনি লিখেছেন, "১৯৭১ সালের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল পাক সেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। তবে এরপরে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে সিমলা চুক্তি চূড়ান্ত হয়। ভারত কোনও কৌশলগত লাভ ছাড়াই ৯৯ হাজার যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দিয়েছিল। আবার পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর মুক্ত করানোও চেষ্টা করা হয় নি বা আনুষ্ঠানিকভাবে সীমানা নির্ধারণও করা হয়নি। যুদ্ধের জন্য বা ভারতের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া উদ্বাস্তু সংকটের জন্য কোনও ক্ষতিপূরণও আরোপও করা হয়নি। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সুবিধা অনুযায়ী তথ্য তুলে ধরা বন্ধ করুন। "

ছবির উৎস,Getty Images
ইন্দিরা গান্ধী, ১৯৭১ ও রিচার্ড নিক্সনের পুরো ঘটনাটা কি?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ইন্দিরা গান্ধীর দূরত্ব কারও কাছেই গোপন ছিল না।
মি. নিক্সন যখন ১৯৬৭ সালে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে মিসেস গান্ধী এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে মি. নিক্সনের সঙ্গে থাকা ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আর কতক্ষণ এই লোকটাকে সহ্য করতে হবে?"
ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে লেখা বইগুলোতে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
দুজনের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা অব্যাহত ছিল ১৯৭১ সালেও।
পূর্ব পাকিস্তানের নৃশংসতার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে ইন্দিরা গান্ধী করতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ইন্দিরা গান্ধীকে মি. নিক্সন ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলেন বৈঠকের আগে।
হোয়াইট হাউসে স্বাগত ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিহারের বন্যা দুর্গতদের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও পূর্ব পাকিস্তানের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি।
বিবিসির রেহান ফজল কয়েক বছর আগে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মহারাজ কৃষ্ণ রসগোত্রার সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই ব্যাপারে।
মি. রসগোত্রা বিবিসিকে বলেছিলেন, "আমি তখন সেখানে ছিলাম। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উদ্দেশ্য ছিল ইন্দিরা গান্ধীকে তার জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়া, তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে অপমান করতে চেয়েছিলেন। আলোচনা প্রথম থেকেই ঠিকমতো চলছিল না।"
মি. রসগোত্রার কথায় "সেই সময়ে ভারতে আসা এক কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু আমাদের ওপরে একটা ভার হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং শিবিরগুলিতে অনাহারে তারা মারা যাচ্ছিলেন, তাদের সম্বন্ধে মি. নিক্সন একটা কথাও বলেন নি।"
মি. রসগোত্রা বলেন, যে ওই ব্যবহারটা মিসেস গান্ধী উপেক্ষা করেছিলেন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে যা বলার ছিল, সেটা বলেও দিয়েছিলেন।
"মূল কথা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যা চলছে তা আপনারা বন্ধ করুন এবং যেসব শরণার্থী আমাদের দেশে এসেছে তারা পাকিস্তানে ফিরে যাবে। আমাদের দেশে তাদের জায়গা নেই – এটাই বলেছিলেন মিসেস গান্ধী," জানিয়েছিলেন মি. রসগোত্রা।

ছবির উৎস,Getty Images
মার্কিন নৌবহর এবং ৭১-এর যুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে তাদের নৌবহর পাঠায়।
ইন্দিরা গান্ধী পরে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফ্ল্যাচ্চিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "আমেরিকানরা যদি একটি গুলিও ছুঁড়ত, অথবা বঙ্গোপসাগরে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কিছু করত তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারত। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এই ভয়টা একবারের জন্যও আমার মাথায় আসেনি।"
অ্যাডমিরাল এসএম নন্দা তার আত্মজীবনী 'দ্য ম্যান হু বম্বড করাচী'তে লিখেছেন, "ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহতেই একটি সোভিয়েত ডেস্ট্রয়ার ও মাইনসুইপার মালাক্কা উপসাগর থেকে এই অঞ্চলে পৌঁছিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার নৌবহরটি ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ওখান থেকে না চলে যাওয়া পর্যন্ত সেটিকে অনুসরণ করেছিল সোভিয়েত নৌবহর।"