
গেল ২০ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করে গেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমে এই খবরটি এসেছে একরকম বার্তা নিয়ে। সেটি হলো বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেখতে চায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। অন্তর্ভুক্তিমূলক মানে হলো কোনো দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যাবে না, এমনকি আওয়ামী লীগকেও না। এই খবরে পুলকিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থকরা, উল্টোদিকে বিক্ষুব্ধ হয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-গণঅধিকার পরিষদসহ ছোট ছোট কয়েকটি দলের নেতারা। তারা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রাখার পক্ষে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদলটি কি আসলেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে এসেছিলো? আন্তর্জাতিক এই সংস্থার কার্যক্রম ঘেঁটে দেখলে তা মনে হয় না। এই সংস্থাটি মূলত বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বড় কোন্দলের পাশাপাশি আন্তর্দেশীয় সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে। এরই অংশ হিসাবে বেশ কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করে আসছে গ্রুপটি।
মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করতে গিয়েই গত বছর আগস্ট মাসে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। নিবন্ধের মূল কথা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নতুন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয় বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান।
এসব পরামর্শের মধ্যে অন্যতম হলো রাখাইন রাজ্যের মানুষের কাছে খাদ্যসহ ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে বাংলাদেশ যেন সাহায্য করে। এই সাহায্য পৌঁছানোর জন্য একটা মানবিক করিডোর তৈরি করে দিতে হবে। খাদ্য ও ত্রাণ পাঠাতে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আরেকটি পরামর্শ হলো বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে রাখাইনের আরাকান আর্মির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যেন এই যোগাযোগের বিষয়টি তদারক করতে পারে সেজন্য একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হবে।
মানবিক করিডোর দিলে আর জাতীয় নিরাপত্তা উপেদেষ্টা নিয়োগ দিলেই কি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হবে? ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপও সেটি মনে করে না। কারণ আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে চরম অবিশ্বাস। এই অবিশ্বাসের কারণ বর্তমানে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সহযোগিতা করছে রোহিঙ্গাদের দুটি সশস্ত্র গ্রুপ। সেই অবিশ্বাস দূর করার জন্য বাংলাদেশকে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছে ক্রাইসিস গ্রুপ। তার একটি হলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও আরাকান আর্মির মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরির জন্য বাংলাদেশকে মধ্যস্থতা করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) তৎপরতা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে গড়ে তুলতে হবে আরেকটি গ্রুপ, যারা আরাকান আর্মির সাথে আলোচনায় বসবে। আরাকান আর্মি গত বছরের ৫ আগস্ট ২০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। আরাকান আর্মিকেও এর তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শুধু বাংলাদেশ বা আরাকান আর্মি নয়, ভারত ও চীনের জন্যও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বেশ কিছু পরামর্শ রয়েছে। তবে আমাদের আগ্রহ বাংলাদেশকে দেওয়া পরামর্শ নিয়ে। এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য যেসব পরামর্শ শুনলেন, তা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না? বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সেসব পরামর্শের সাথে মিলছে কি?
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়ার পরই অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, আমরা রাষ্ট্রবিহীন একটি প্রতিবেশী পেতে যাচ্ছি। এমনকি তিনি আগামী কিছুদিনে মানচিত্র বদলে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলেছেন। অনেকে তখন বাংলাদেশের মানচিত্রের কথা মনে করে উদ্বিগ্ন হলেও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আসলে মিয়ানমারের মানচিত্রের কথাই বলতে চেয়েছেন। তবে সরকারি অবস্থান থেকে আরেক দেশের মানচিত্র বদলের কথা বলা যায় না, তাই তিনি মিয়ানমারের নাম উচ্চারণ করেননি। রাখাইন ও আরাকান আর্মিকে বছরখানেক আগে থেকেই রাষ্ট্রবিহীন শক্তি বলে ডেকে আসছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ।
এর মাঝে ছোট্ট করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ২০২১ সালে পাস হওয়া বার্মা অ্যাক্টের কথাও বলে নিই। সেই অ্যাক্ট অনুযায়ী মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এই অঞ্চলের অন্যদের সহযোগিতা নিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরসহ অন্যান্য এজেন্সি। এমনকি তারা মিয়ানমারে জেলবন্দি রাজনীতিবিদদের সমর্থক গ্রুপগুলোকেও সহায়তা করবে। বলে রাখা ভালো, চীনকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে আসার সহজ রাস্তা দিতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকার খলিলুর রহমান নামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তাকে হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ করেছে অনেক আগেই। তাকেই চলতি মাসে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। একেবারে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ!
বাকি ছিলো রাখাইনে যুদ্ধের কারণে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষকে খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা পাঠাতে মানবিক করিডোর প্রদান। এর একটি গোপন উদ্দেশ্য আছে। আরাকান আর্মি বাইরের অর্থনৈতিক সাহায্য ছাড়া দীর্ঘদিন রাখাইন রাজ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। তাই মানবিক করিডোরের মাধ্যমে সেই অর্থনৈতিক সাহায্য পাবে আরাকান আর্মি।
গোপন উদ্দেশ্য যা-ই হোক, প্রকাশ্য উদ্দেশ্য মানবিক সহায়তা। তাই এই করিডোর দিতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে রাজি বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের পরামর্শে সবই তো হলো, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার লেজেগোবরে করলোটা কী? সেটি হলো প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র সংঘাতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলার মতো বড় সিদ্ধান্ত একাই নিয়ে ফেলছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন দেশে কোনো সংসদ নেই, তাই এ নিয়ে সংসদে আলোচনার সুযোগও নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায় দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য। কিন্তু কোনো দলের সাথেই আলোচনা করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে মানবিক করিডোর দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল।
লেজেগোবরে অবস্থা আরো আছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দেশীয় সাংবাদিকদের জানালেন সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া জানার পরদিনই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বললেন, এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এর পরদিনই আবার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিদেশি একটি বার্তা সংস্থার কাছে মানবিক করিডোর দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন!
অবশ্য পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা দুজনেই বলেছেন জাতিসংঘ মানবিক করিডোরের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দেবে। ওদিকে আবার জাতিসংঘ বলছে মিয়ানমারের সরকার ও সশস্ত্র গ্রুপের অনুমতি ছাড়া মানবিক করিডোর সম্ভব নয়।
যেখানে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ সেই অনুমতিই পেলো না, সেখানে বাংলাদেশ কাদের প্রস্তাবে মানবিক করিডোরে নীতিগত সম্মতি দিলো? সেই ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। তারা কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের অনুমতি না পেলে শুধু আরাকান আর্মির সাথে গোপন আলোচনা করে আনঅফিসিয়াল মানবিক করিডোর দেয়ার পরামর্শও দিয়ে রেখেছে!
সম্ভবত গোপনে মানবিক করিডোরের বিষয়টিই চাইছিলো জাতিসংঘ ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সেটা সাংবাদিকদের জানিয়ে দেওয়ায় এখন সবটাই গুবলেট পাকিয়ে গেছে।
(ঢাকাটাইমস