
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হামলার পরেও হামাসের মনোবল দৃঢ় রয়েছে। এই যুদ্ধ বন্ধ না হওয়ার পেছনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মনোভাবকে দায়ী করা হচ্ছে। এ অবস্থায় হামাস ইসরায়েলের কাছে কেন আত্মসমর্পণ করবে না, তা নিয়ে লিখেছেন মিডল ইস্ট আইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট। ২২ এপ্রিল লেখাটি মিডল ইস্ট আইয়ের অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে।
গাজাকে আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন—হত্যার ময়দান; রক্ত, যন্ত্রণা ও মৃত্যুর অবিরাম চক্র কিংবা বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাতিগত বন্দিশালা।
তেল আবিবের আশকেনাজি ইহুদিরা পশ্চিমা বুদ্বুদের মধ্যে বসবাস করেন। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকা বা রুয়ান্ডার পর বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যাবলি থেকে মাত্র এক ঘণ্টা গাড়ি চালানোর দূরত্বে বসে কাপুচিনোর মগে চুমুক দিয়ে যোগব্যয়ামের শিক্ষক বিষয়ে গজগজ করতে করতে তাঁরা দিন শুরু করেন। কিন্তু একটা বিষয় তাঁদের কেউই বুঝতে পারছেন না, সেটা হলো এই যে হামাস আত্মসমর্পণ করবে না।
টানা ১৮ মাস ধরে চলা যুদ্ধ এবং ২ মাস ধরে অনাহারের পর গাজার নেতারা টাকা নিয়ে ভেগে যাবেন, যেমনটা একবার ফাতাহ নিয়েছিল—এমন কথা ভাবাটা অজ্ঞতা। এমন প্রত্যাশা বলে দেয়, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর শত্রুকে কতটা কম বোঝেন।
হামাসের প্রতি ইসরায়েলের শেষ ‘প্রস্তাব’ যে কার্যত তাদের আত্মসমর্পণে গড়াত, তা বুঝতে ভুল করার অবকাশ নেই। এ প্রস্তাবের মানে আসলে ৪৫ দিনের মতো খাবার ও পানির বিনিময়ে সব ইসরায়েলি জিম্মিকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং হামাস সদস্যদের নিরস্ত্র করার উদ্যোগ নেওয়া।
এ প্রস্তাবের জবাবে হামাস বলেছিল, তারা ইসরায়েলের কারাগারে থাকা নির্দিষ্টসংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে তৈরি আছে। শুধু তা–ই নয়, তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতিরও প্রস্তাব করেছিল, যার আওতায় হামাস নিজেদের সুড়ঙ্গগুলো আবার তৈরি করবে না কিংবা অস্ত্র বানাবে না এবং গাজার শাসন ফিলিস্তিনের অন্য দলগুলোর কাছে হস্তান্তর করবে।
তবে এ যুদ্ধের শুরুতে দেওয়া দুটি শর্ত থেকে সরে আসেনি হামাস। একটি শর্ত হলো—তারা নিরস্ত্র হবে না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তারা গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং যুদ্ধের সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত সমাপ্তি চায়।
নেতানিয়াহু একজন অন্তর্ঘাতী নাশকতাকারী
এটা বারবার সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে অন্তরায় নেতানিয়াহু নিজেই। তিনি দুই দফায় হামাসের সঙ্গে চুক্তি করেছেন, কিন্তু একতরফাভাবে নিজেই তা ভেঙে দিয়েছেন।
সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে একটি পর্যায়ক্রমিক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হন নেতানিয়াহু, এর সুবাদে ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। কথা ছিল, দ্বিতীয় ধাপে যুদ্ধবিরতি ও গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করবে ইসরায়েল।
কিন্তু নেতানিয়াহু সেই চুক্তি একটানে ছিঁড়ে ফেলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে এটা করতে দেন। যদিও চুক্তিনামাটির কৃতিত্ব একসময় ট্রাম্প নিজেই দাবি করেছিলেন।
পারস্পরিক সম্মতিতে নেতানিয়াহু যুদ্ধে ফিরে যান শুধু বাজেটবিষয়ক ভোটে আসন্ন পরাজয় থেকে নিজের জোটকে বাঁচাতে। যুদ্ধের সামরিক লক্ষ্যগুলো অনেক আগেই ব্যবহার করা হয়ে গেছে।

গাজা যুদ্ধ বন্ধ করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দূতদের নেতানিয়াহুর সঙ্গে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ট্রাম্পের সাবেক জিম্মিবিষয়ক দূত অ্যাডাম বয়েহলারকেও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। হামাস সরাসরি দর–কষাকষির মাধ্যমে জিম্মি বিনিময়ের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি স্বাধীন চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু নেতানিয়াহু এ কথা জানতে পেরে গণমাধ্যমে ফাঁস করে দেন।
হামাস আত্মসমর্পণ করবে না
হামাস এবং গাজাবাসী প্রতি রাতে যে সাজা ভোগ করছে, তাতে সংগঠনটির নত না হওয়ার অনেক কারণ আছে। গত মার্চ মাসে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় হামলা চালানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের হামলায় হামাসের প্রথম সারির নেতৃত্ব, বেসামরিক সরকার, পুলিশ এবং প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে। রাফাও ধ্বংস করা হচ্ছে। তবু দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যাওয়ার বিনিময়ে মোটা টাকা দেওয়ার প্রস্তাবকে তারা অগ্রাহ্য করে চলেছে।
ফিলিস্তিনের প্রয়াত নেতা ইয়াসির আরাফাত অনেক আগেই নির্বাসনে চলে যেতেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন ১৯৮২ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের পশ্চিমে অবস্থিত ফিলিস্তিনি বাহিনীদের ইসরায়েল অবরুদ্ধ করার পর। ফাতাহ এতক্ষণে বিমানে উঠে পড়ত।
কিন্তু এই উদাহরণগুলোর কোনোটিই হামাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেন?
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা এবং দক্ষিণ ইসরায়েলে চালানো নৃশংসতা যদি ইসরায়েলকে চিরতরে বদলে দেয়, তেমনি গাজার ধ্বংসযজ্ঞও ফিলিস্তিনি লক্ষ্য–আদর্শকে আমূল বদলে দিয়েছে।
দুনিয়ার নানা প্রান্তে ফিলিস্তিনিদের কাছে গাজা হয়ে উঠেছে পবিত্র ভূমি। গাজার এমন কোনো পরিবার নেই যারা এই যুদ্ধে আত্মীয়স্বজন কিংবা তাদের ঘরবাড়ি হারায়নি।
হামাস কিংবা অন্য কোনো প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। এই মানুষদের জন্যই তারা লড়াই করছে। সম্মিলিত দুর্ভোগ যত বাড়ছে, ততই নিজেদের ভূমিতে থাকার সম্মিলিত ইচ্ছাও বাড়ে, যেমনটি দক্ষিণ হেবরনের নিরস্ত্র কৃষকেরা করেছিলেন।
ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করা
ইসরায়েল কখনো জমি বা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না। তারা সব সময়ই আরও বেশি চায়। তারা এই জায়গায় কখনোই অন্য ধর্মের ওপর তাদের ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া বন্ধ করতে পারবে না। ইস্টার সানডের সময় খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের মতোই ইসরায়েলের আধিপত্যবাদী কর্মকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
দখল করা পশ্চিম তীরে অসলো চুক্তির পর ইহুদি বসতি স্থাপনের ইতিহাস প্রমাণ করে, যুদ্ধের সময়ের চেয়ে শান্তির সময়ে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন বেশি জোরদার থাকে।
ইসরায়েল দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান মানে না। কারণ, দেশটির প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁদের উত্তরসূরিরা মনে করেন, এখানে শুধু একটি রাষ্ট্রই ছিল। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেনগভি, অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সম্মিলিতভাবে ‘ইসরায়েলের ভূমি’ থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করার কাজটি ‘শেষ’ করছেন মাত্র। ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন গুরিওন কাজটি শুরু করে পরে বন্ধ করেছিলেন।
কৌশলগত বিষয়
হামাসের সম্মিলিত শৃঙ্খলা ও বিশ্বাস তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত হতে দেয়নি। এটি সবার ওপর প্রভাব ফেলে।
২৩ বছর বয়সী প্যারামেডিক রিফাত রাদওয়ানের মৃত্যুকালীন কথা তাঁর ফোনে ধারণ করা আছে। তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়ার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি ধর্মকর্ম চর্চায় অতটা নিয়মতি ছিলেন না কিংবা হামাসের সদস্যও ছিলেন না, কিন্তু মৃত্যুর সময় ক্ষমা চাওয়ার মতো ধার্মিক ছিলেন।
অবিশ্বাস্য প্রতিকূলতার মুখে গাজার ফিলিস্তিনিরা যে সাহসিকতা ও ত্যাগ স্বীকার করছেন, কখনো তার যদি কোনো প্রতীক থাকে, তাহলে রাদওয়ানই ছিলেন সেই প্রতীক। মৃত্যুশয্যায়ও তাঁর বিশ্বাস টলানো যায়নি। গাজার বিশ্বাসও অটল থাকবে।
হামাস কেন হাল ছাড়বে না, তার আরও কিছু কম প্রত্যক্ষ কারণ আছে।
হামাসের ভাগ্যে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। সংগঠনটি বিশ্বাস করে, তারা তাদের কৌশলগত লক্ষ্যও অর্জন করে ফেলেছে। তামিল টাইগার্স বা চেচেন বিদ্রোহীদের বল প্রয়োগ করে দমন করা হয়েছে। অন্যদিকে স্পেনের ইটিএর মতো বিদ্রোহীরা মূল লক্ষ্য অর্জন ছাড়াই হাল ছেড়ে দিয়েছে।

কৌশলগত লক্ষ্যটি হলো, ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্রে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বিশ্বের মানবাধিকার এজেন্ডার শীর্ষে ফিরিয়ে আনা।
পিউ রিসার্চের গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি ধারণা নেতিবাচক হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক (৫৩ শতাংশ) ইসরায়েল সম্পর্কে প্রতিকূল মনোভাব প্রকাশ করেছেন। ৭ অক্টোবরের আগের চেয়ে এই হার ৯ শতাংশ বেশি।
জনমতের যুদ্ধে হামাস জিতে যাচ্ছে আর ইসরায়েল হেরে যাচ্ছে, বিশেষ করে যেসব দেশে হামাসকে নিষিদ্ধ সংগঠন ঘোষণা করা হয়েছিল সেখানে। আইন মানুষকে বলছে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ভাবতে, কিন্তু তাঁরা ক্রমেই তা চাচ্ছেন না। যদিও তাঁরা মনে করেন, ৭ অক্টোবর কাজটা খুব খারাপ হয়েছিল।
জটিল আলোচনা
ট্রাম্পের দূতরা বর্তমানে একই সঙ্গে তিনটি জটিল আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন, প্রতিটি আলোচনা কতটা আয়ত্তের অতীত।
এ তিনটি বিষয়ের মধ্যে গাজা একটি। তবে এ বিষয়টিতে ট্রাম্প দ্রুত সমাধান চান। তাঁর ধৈর্য নেই যে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে কোনো জটিল বিষয়ের পেছনে ছুটবেন। আর এর মধ্যে দুটি সংঘাত গভীরভাবে পরস্পর সংযুক্ত।
ইরানে হামলা চালাতে যেসব দেশ নিজেদের আকাশসীমা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিষিদ্ধ করছে, সে দেশগুলোই গাজা থেকে বিপুল জনগোষ্ঠীকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বিরোধিতা করছে। এ ছাড়া সিনাই নিয়ে ইসরায়েল ও মিসর প্রকাশ্য শত্রুতার মধ্যে রয়েছে, তারা একে অপরকে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে দায়ী করছে।
যদি ইরানের সঙ্গে ট্রাম্পের আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা হামলা চালানোর জন্য নতুন করে চাপ দেবেন। তখন গাজার জন্য কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাস্তববাদী নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসছে। তাঁর হাতে খেলার জন্য যতগুলো তাস আছে তিনি মনে করছেন, এগুলো আসলে তাঁর কাছে থাকবে না।