Image description

গাজায় চলমান সংকট ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি ট্রাম্পের মন্তব্য এবং তার প্রশাসনের কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিচারিতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্পের চাপ এবং গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সবুজ সংকেত দেওয়া, এই দ্বৈত নীতি এখন স্পষ্ট। গাজার পরিস্থিতি, ইসরায়েলের চুক্তি লঙ্ঘন, ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এ প্রতিবেদন।

ইউক্রেনে শান্তির বার্তা, গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ

এ বছরের মার্চে গাজার অবরুদ্ধ অঞ্চল আবারও ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার হয়। গত ১৮ ও ১৯ মার্চের ভোরে নির্বিচার বোমা হামলায় হাজারের বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছেন। এ হামলার পেছনে ইসরায়েলের যুক্তি ছিল, তারা যুদ্ধবিরতির শর্ত পুনর্নির্ধারণের চেষ্টা করছে। এর আগেও গাজার অবস্থা ছিল উত্তপ্ত, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করেছে।

 

অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে শান্তির বার্তা দিয়েছেন। তবে গাজার ক্ষেত্রে তার নীতির মধ্যে এক ধরনের দ্বিচারিতা লক্ষ্য করা যায়। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্প যে চাপ সৃষ্টি করছেন, বিপরীতে গাজায় তিনি ইসরায়েলকে আগ্রাসন চালানোর অনুমোদন দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের এই দ্বৈত নীতির কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প যখন ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কথা বলছেন, তখন গাজায় রক্তপ্লাবন অব্যাহত রেখেছেন।

 
 

ইসরায়েলের চুক্তি লঙ্ঘন: ১৯৯৩-২০২৫

 

ফিলিস্তিনবিষয়ক চুক্তি ও সমঝোতাগুলো ইসরায়েল ধারাবাহিক লঙ্ঘন করে আসছে। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) একে অপরকে স্বীকৃতি দেয়। একইসঙ্গে দুই-রাষ্ট্র নীতির ভিত্তি স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু চুক্তির পরপরই ইসরায়েল তার দখলদারি বাড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের মাটিতে নতুন বসতি স্থাপন শুরু করে, যা মূল চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন। এমনকি, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসলে পূর্ববর্তী চুক্তি বাতিল করার চেষ্টা চালিয়েছে।

২০০৩ সালে ‘রোডম্যাপ টু পিস’ নামে একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করা হয়েছিল, তবে ইসরায়েল নতুন শর্ত চাপিয়ে দেয়। শর্তটি ছিল ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলকে ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তারা রাজি না হলে তাদেরকে ‘শান্তির অন্তরায়’ হিসেবে দোষারোপ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েল শুধু এসব কার্যকলাপ ফিলিস্তিনেই নয়, লেবানন ও সিরিয়ার সঙ্গেও চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে চলেছে।

গাজার বর্তমান সংকট: ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা

গাজায় সহিংসতা ও মানবাধিকার সংকট চরম অবস্থায় রয়েছে। গত ১৫ মার্চ গাজার এক ত্রাণ দলের ওপর হামলা চালিয়ে ৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩ জন সাংবাদিকও ছিলেন। এরপরই নতুন করে বিমান হামলা চালিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ৫০০ বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতার গাজার যুদ্ধবিরতির প্রধান মধ্যস্থতাকারী হলেও তারা ইসরায়েলকে চুক্তি মানতে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হতো, তবে তারা ইসরায়েলকে বাধ্য করত চুক্তি মানতে। কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলকে চুক্তি পরিবর্তনের অনুমতি দিয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করব!’—এটিই ইসরায়েলের জন্য আগ্রাসন চালানোর সবুজ সংকেত ছিল। এ বক্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। মার্কিন প্রশাসন ইসরায়েলের পক্ষে থাকায় ইসরায়েল আরও দখল ও বসতি স্থাপনে উঠেপড়ে লেগেছে।

ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ: ট্রাম্পের অমানবিক মন্তব্য

ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি মন্তব্য করেছিলেন, গাজার জনগণকে মিশর, জর্ডান বা অন্য কোথাও পুনর্বাসিত করা উচিত। এটি শুধু একটি অমানবিক মন্তব্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অপরাধ। ট্রাম্পের এ মন্তব্যের পর ইসরায়েল গাজার অবকাঠামো ধ্বংসে নামে। একইসঙ্গে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন একেবারে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, ফিলিস্তিন কেবল একটি ভূখণ্ড নয়। এর হাজার হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। এই ভূমির সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের শুধু ভৌগোলিক সম্পর্কই নয়, এটি তাদের সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহাসিক পরিচয়ের অংশ। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা মানে তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মমর্যাদা ধ্বংস করা।

যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ বা তাদের ওপর আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। ১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন এবং রোম স্ট্যাটিউট অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) অনুসারে, কোনো জনগণকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। ট্রাম্পের মন্তব্য আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার হরণের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে।

শান্তির সম্ভাবনা আরও দূরে

গাজার পরিস্থিতি ও ট্রাম্পের নীতি শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজার মানবিক সংকট, ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে একটি বড় প্রশ্নের বিষয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র সঠিকভাবে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হতে চাইতো, তাহলে তারা ইসরায়েলকে শান্তির শর্ত মেনে চলতে বাধ্য করতো। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায়, শান্তির সম্ভাবনা আরও দূরে চলে গেছে।

ফিলিস্তিনিদের প্রাণপণ সংগ্রাম

ফিলিস্তিনিরা জীবন গেলেও মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে রাজি নয়। তারা তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখতে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের উচিত ফিলিস্তিনিদের এই সংগ্রামে সমর্থন জানানো এবং তাদের অধিকার রক্ষায় একযোগভাবে কাজ করা। আইন অনুসারে, ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমিতে থাকার অধিকার রয়েছে এবং তাদের এ অধিকার রক্ষা করা একটি নৈতিক ও যৌক্তিক দায়িত্ব। তবে শান্তির নামে যুদ্ধ সমর্থন করা এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার লঙ্ঘন করা শুধু কূটনৈতিক নয়, আইনগত ও নৈতিকভাবে অপরাধ। যতদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলকে তার চুক্তি মানতে বাধ্য করবে না, ততদিন পর্যন্ত এই সংকটের সমাধান অসম্ভব হবে।